স্টাফ রিপোর্টার।।
সংবাদ প্রকাশের জেরে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) সাংবাদিকদের উপর মব তৈরি করে হেনস্তার ঘটনা ঘটেছে। বুধবার (১০ সেপ্টম্বর) দিবাগত রাত আনুমানিক ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয়-২৪ হলের ৩০৫ নম্বর কক্ষে এ ঘটনা ঘটে। আইন অমান্য করে এমন মব তৈরি করাকে ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার জন্য হুমকিস্বরূপ মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ভুক্তভোগী সাংবাদিক হলেন নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল কুমিল্লা নিউজ-এর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি বি. এম. ফয়সাল এবং একই কক্ষে অবস্থানরত মানবকন্ঠের সাংবাদিক জুবায়ের রহমান ও খোলা কাগজ'র হাছিবুল ইসলাম সবুজ। এসময় সেখানে উপস্থিত রূপালী বাংলাদেশের সাংবাদিক জাহিদুল ইসলাম ও দৈনিক কুমিল্লার ক্যাম্পাস সাংবাদিক মাসুম।
প্রত্যক্ষদর্শী ও ভিডিও ফুটেজের সূত্রে জানা যায়, সংবাদ প্রকাশকে কেন্দ্র করে বিজয় ২৪ হলের ৩০৫ রুমে এসে দরজায় ধাক্কা দিয়ে ফয়সালকে হুমকি দিতে শুরু করেন কয়েকজন। এরপর ২০-২৫ জন এসে মব তৈরি করার চেষ্টা করে। তখন মানবকন্ঠের সাংবাদিক জুবায়ের হোসেন বেড থেকে উঠে তারা কেন এসেছেন প্রশ্ন করেন। এসময় মব সৃষ্টিকারীরা ভুক্তভোগী ফয়সালকে বের করে আনার নির্দেশ দেয় এবং সাংবাদিকদের দিকে তেড়ে আসেন। এসময় প্রতিবাদ করলে তারা সাংবাদিকদের ধাক্কা দিয়ে ফয়সালকে মারতে তেড়ে আসে এবং সাংবাদিকদের দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়। এসময় সেখানে রূপালী বাংলাদেশ'র সাংবাদিক জাহিদুল ইসলাম উপস্থিত হতে গেলে আইন বিভাগের শিক্ষার্থী জহিরুল ইসলাম পলাশ সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে 'ধর ধর' বলে গলা চেপে ধরে।
জানা গেছে, বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে অর্থনীতি বিভাগের ১৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী অন্তু দাস নিয়ম ভেঙে বিজয়-২৪ হলের ৩১২ নম্বর কক্ষে বহিরাগত এক নারী (যাকে ‘খালা’ পরিচয়ে এনেছিলেন) এবং আরও দুজন পুরুষ নিয়ে আসেন। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করলে অন্তু দাস সাংবাদিকদের 'বাড়াবাড়ি না করতে' বলেন। তিনি দাবি করেন, হলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আমিরুল ইসলামের অনুমতি নিয়েছিলেন। তবে ওই কর্মকর্তা জানান, তিনি কোনো অনুমতি দেননি এবং বিষয়টি তার জানা নেই।
বিশ্ববিদ্যালয় হল প্রভোস্ট সূত্রে জানা যায়, হলে আইন অনুযায়ী বহিরাগত প্রবেশ নিষিদ্ধ রয়েছে। ঐ ঘটনার পর হল প্রভোস্ট আবারও একটি বিজ্ঞপ্তি দেন। সেখানে বলা হয় হলের কোনো শিক্ষার্থীদের গেস্ট (পুরুষ-মহিলা) হলের ভিতরে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত করা হয়েছে। বিশেষ কারণবশত, হল প্রশাসনের অনুমতি সাপেক্ষে বিবেচনা করা যেতে পারে।'
হলে বহিরাগত প্রবেশে নিয়ে সাংবাদিক ফয়সাল "কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় বিজয়-২৪ হল কক্ষে বহিরাগত নারী-পুরুষ; শিক্ষার্থীরা বিব্রত" শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করেন। এই সংবাদের জের ধরে রাত ১২টার দিকে প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন শিক্ষার্থী ফয়সালের কক্ষে গিয়ে মব তৈরি করে হামলার চেষ্টা চালায় এবং উপস্থিত অন্যান্য সাংবাদিকদের হেনস্তার চেষ্টা করে।
মব তৈরি করা হামলাকারীদের মধ্যে ছিলেন অর্থনীতি বিভাগের মোহাম্মদ হাসান ও মোহাম্মদ ফয়সাল, নৃবিজ্ঞান বিভাগের ১৫ ব্যাচের শিক্ষার্থী তন্ময় সরকার, নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রান্তিক অঙ্গন দাশ, আইন বিভাগের শিক্ষার্থী জহিরুল ইসলাম পলাশ, বাংলা বিভাগের জয় ঘোষ ও রকিবুল ইসলাম জিসান, গণিত বিভাগের ফারহান, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আরেফিন তাজবীহ, ইংরেজি বিভাগের কাজী তাহসিন ও রুহিত পাল এবং মার্কেটিং বিভাগের সাজিদসহ অনেকে।
ভুক্তভোগী সাংবাদিক বি. এম. ফয়সাল বলেন, "আমি রুমে বসে পড়ছিলাম। হঠাৎ হলের বর্ধিত অংশ থেকে প্রায় ২০-২৫ জন আমার নাম ধরে ‘ধর ধর’ বলে মব তৈরি করে রুমে প্রবেশ করে। তখন আমার রুমমেট জুবায়ের ভাই বাধা দিতে গেলে তার ওপর আক্রমণাত্মক আচরণ করে। পরে আরো কিছু শিক্ষার্থী মবের উদ্দেশ্যে সেখানে উপস্থিত হয়।
সাংবাদিকের হাতে আসা ভিডিও ও মেসেঞ্জার গ্রুপের স্ক্রিনশটে দেখা যায়, নৃবিজ্ঞান বিভাগের তন্ময় সরকার মব তৈরি করার জন্য উসকে দেয়। তিনি মেসেঞ্জার গ্রুপে লিখেন, ১৫ ব্যাচের সবাই উপরে আয় ১৮ এত্ত সাহস কেমনে পায়। এর পর হলের কিছু শিক্ষার্থীের নিয়ে মব করার উদ্দেশ্যে ভুক্তভোগীর কক্ষে চলে যান। প্রতিবেদকের হাতে থাকা ভিডিওতে দেখা যায়, তন্ময় ও প্রান্তিক সরকার ভুক্তভোগীদের সাথে উচ্চবাচ্য করেন এবং মারতে এগিয়ে আসেন।
এসব বিষয়ে জানতে তন্ময় সরকারকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, জুনিয়র যদি বেয়াদবি করে তখন আমি কী বসে থাকবো? আমি গ্রুপে মেসেজ দিয়েছি সবাইকে আসার জন্য। আর আমি সেখানে মব কন্ট্রোল করার জন্যই গিয়েছি।
সাংবাদিককে 'ধর ধর' বলে তার গলা চেপে ধরার বিষয়ে জানতে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও জহিরুল ইসলাম পলাশ ধরেননি।
আরেকটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, অভিযুক্ত অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ফয়সাল ভুক্তভোগী সাংবাদিককে মারার উদ্দেশ্যে তার কক্ষে প্রবেশ করেন। এসময় কক্ষের অন্য সাংবাদিকরা তাকে বাধা দিলে তাদের সাথে উচ্চবাচ্যে কথা বলা শুরু করেন।
তবে অভিযুক্ত অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ফয়সাল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, "আমি ঐ রুমে যাইনি এবং কিছু করিনি। তবে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম।"
মব তৈরি করে হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে বিজয় ২৪ হলের প্রভোস্ট ড. মাহমুদুল হাসান খান বিষয়টি এড়িয়ে যান।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় আইন ও বিধি অমান্য করে সাংবাদিকদের উপর মব তৈরি করা ও হেনস্তা করার ঘটনাকে ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার জন্য হুমকিস্বরূপ বলে মনে করছেন শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্টরা।
বিজয় ২৪ হলের শিক্ষার্থী নাঈম ভূঁইয়া বলেন, ''সাংবাদিক যদি যদি কোনো ধরনের ভুল করে থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে লিগ্যাল অ্যাকশন নেয়া টাই ঠিক। কোনোভাবেই মব লিঞ্চিং করা ঠিক নয়, এটা অন্যায়। এছাড়াও 'মা-খালা যাইহোক অনুমতি ব্যাতীত হলে প্রবেশ করানো ঠিক হয়নি।"
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুল হাসান বলেন, "কোনো সাংবাদিক যদি মিথ্যা তথ্য বা কোনো কিছুকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে তাহলে সংশ্লিষ্ট পত্রিকায় প্রতিবাদ লিপি পাঠানো যায়। যদি তাতেও না হয় প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ করা যায় ও আইনি পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। কাউকে বিচার বহির্ভূতভাবে শাস্তি দেয়া যায় না।"
বিশ্ববিদ্যালয় উপ উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাসুদা কামাল বলেন, "সাংবাদিক সংবাদ প্রকাশ করবেই। তবে যদি সাংবাদিক মিথ্যা তথ্য ছড়ায় তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তা না করে সাংবাদিককে হেনস্তা কিংবা মব তৈরি করে হামলা করা কোনো ভাবেই কাম্য নয়।"
উল্লেখ্য, উল্লেখ্য, বিজয়-২৪ হলে অবাধে বহিরাগতদের প্রবেশের কারণে গত তিন বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে মোবাইল, ল্যাপটপ ও হলের সরঞ্জামাদি চুরি হয়ে আসছে বলে যায়। সবশেষ, গতমাসের ৩১ তারিখে ৪২৩ নম্বর কক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের দুইটি ল্যাপটপ, দুইটি মোবাইল ফোন এবং নগদ টাকা চুরির ঘটনা ঘটে।