বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের বৈঠকে বক্তারা- রাষ্ট্র মেরামতের কাজে সরকারকে সময় দেয়া প্রয়োজন

গাজী জাহাঙ্গীর আলম জাবির।।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের একক জাতীয় রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট আয়োজিত “ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে জাতির প্রত্যাশা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক আজ ৬ অক্টোবর (রবিবার) সকাল- ১০ টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলরুমে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে । বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের চেয়ারম্যান মাওলানা এম এ মতিনের সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠকে লিখিত প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংগঠনের মহাসচিব স উ ম আবদুস সামাদ। উক্ত গোল টেবিল বৈঠকে বক্তব্য রাখেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব। এসময় বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট চেয়ারম্যান বলেন-বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একেকটা নতুন ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে।

সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে গড়ে উঠা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন পরবর্তীতে দেশের সর্বস্তরের আপামর জনতার গণআন্দোলনে পরিণত হয়। ফলশ্রুতিতে ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানে জনগণের ভোটাধিকার হরণকারী একদলীয় সরকারের পতন হয়।

গোলটেবিল বৈঠকের শুরুতে তিনি ছাত্রজনতার আন্দোলনে শাহাদাতবরণকারী প্রত্যেক শহীদকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ এবং আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন। তিনি আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্তদের পূনর্বাসনের দাবি জানিয়ে বলেন- ছাত্রজনতার এ আন্দোলনকে কয়েকটি রাজনৈতিক দল তাদের দলীয় অর্জন বলে চালিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত। অথচ বিগত সরকারের দলীয় অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন ব্যতীত দেশের দলমত নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণে এ বিজয় অর্জিত হয়েছে, যা কারো একক অর্জন নয়। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সূচনা হতে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের নির্দেশনা অনুযায়ী আমাদের সহযোগী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা পুরো আন্দোলনে রাজপথে ছিল।

বিগত ৫ জুলাই ছাত্রসেনার পক্ষ হতে জেলা-সমমান এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য কেন্দ্রীয় পরিষদের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয় এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর হামলার প্রতিবাদে ১৭ জুলাই’২৪ ইংরেজি তারিখ হতে ছাত্রসেনা ৪ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে দেশব্যাপি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। সক্রিয় আন্দোলনে অংশ নেয়ার কারণে সরকারি দল ও পুলিশের হামলায় শতাধিক ছাত্রসেনাকর্মী আহত ও গুলিবিদ্ধ হন। পরবর্তীতে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্তৃত্ববাদী সরকারের মিথ্যা ও হয়রানি মূলক মামলা দিয়ে ১৮ জন ছাত্রসেনার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টও শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনে রাষ্ট্রিয় নিপীড়নের নিন্দা এবং সর্বশেষ ছাত্রদের দাবির প্রতি একাত্বতা প্রকাশ করে সংবাদ সম্মেলন করেও সমর্থন জানিয়েছিল। এভাবে দেশের সর্বস্তরের ছাত্র-জনতার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় যে নতুন বাংলাদেশের সূচনা হয়েছে, তা টেকসই করতে হবে। সুখী, সমৃদ্ধ ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে হলে সবাইকে হাতে হাত মিলিয়ে দেশের স্বার্থে কাজ করতে হবে এবং অন্তবর্তীকালীন সরকারকে প্রয়োজনীয় সহযোগীতা ও সময় প্রদান করতে হবে।লিখিত বক্তব্যে মহাসচিব স উ ম আবদুস সামাদ বলেন -গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী যে কোন দেশে সুযোগসন্ধানী, স্বার্থন্বেষী মহল ও দুষ্কৃতিকারীরা পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে শান্তি-শৃঙ্খলা সস্প্রীতি বিনষ্টের অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকে, ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়।

আমাদের দেশেও বর্তমান দুষ্কৃতিকারীরা গণঅভ্যুত্থানের সুযোগে দুষ্কর্ম করে যাচ্ছে, যে কারণে ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তীকালীন সরকারের দেশ গড়ার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে । আমরা মনে করছি, আমাদের দেশে ইসলাম প্রচারকারী মহান আউলিয়া কেরামের ৪০টি মাজারে হামলা ও ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, জাতীয় বায়তুল মোকাররমকে রণক্ষেত্রে পরিণত করেছে, দেশের বিভিন্ন মসজিদে চর দখলের মতো দখল, হামলা ও ইমাম-খতিবদের জোরপূর্বক হুমকি-অপসারণ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করা, কিশোরগঞ্জ-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) এর জুলুসে হামলা করে একজনকে শহীদ ও শতাধিক আহত করা, অন্যান্যধর্মের অনুসারীদের উপনালয়ে হামলা-ভাংচুর করার মাধ্যমে শান্তি-সম্প্রীতি বিনষ্ট করা হচ্ছে। বিশেষত: পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদেশী মদদপুষ্ট অস্ত্রধারীরা দেশের আঞ্চলিক অখন্ডতা, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে বিষোদগার করে শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এসব কিছুর মাধ্যমে দুষ্কৃতিকারারী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, সরকার অস্থিতিশীল ও জাতীয়-আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার অপচেষ্টা বলে আমরা মনে করি।

এক্ষেত্রে সরকারকে আমরা পূর্ণ সহযোগিতা দিতে চাই। তাই যৌথ বাহিনীর মাধ্যমে দ্রুত অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের পাশাপাশি ওইসব দুষ্কৃতিকারী সন্ত্রাসী উগ্রবাদী গোষ্ঠিদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।তিনি বলেন- স্বচ্ছতা, সামাজিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় বিশ্বাস, সুশাসন, ন্যায় বিচার, নেতৃত্বের জবাবদিহীতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ প্রভৃতির মাধ্যমে দুর্নীতিমুক্ত সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়া সম্ভব। তাই বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট নিম্নোক্ত প্রস্তাবনা উপস্থাপন ও পরামর্শের মাধ্যমে সরকারকে সহযোগীতা করতে বদ্ধ পরিকর। ইতোমধ্যে রাষ্ট্র সংস্কারে পাঁচটি পূর্ণাঙ্গ কমিশন গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। কমিশনগুলো হলো—নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন ও পুলিশ। এসব কমিশন যদি আমাদের সহায়তা নিতে চায়, তবে আমরা সহায়তা করতে প্রস্তুত আছি।যেকোন বিপ্লবী সরকারের নিকট জাতির প্রত্যাশা বেশি থাকে। বর্তমানে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সৃষ্ট অন্তবর্তীকালীন সরকারের নিকট জাতির অনেক প্রত্যাশা রয়েছে। আমরা মনে করছি, নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি সরকার গুরুত্ব দিলে দেশ-জাতি উপকৃত হবেন।

* বিগত একদলীয় সরকারের আমলে বিদেশে পাচারকৃত দেশের সব অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। এতে রিজার্ভ সংকট দূর হবে।

* স্বীকৃত দুর্নীতিবাজ, বিদেশে বেগমপাড়া গড়া অর্থপাচারকারীদের দেশে ফিরিয়ে এনে আইনের মুখোমুখি করতে হবে। এতে ভবিষ্যতে কেউ দুর্নীতি করতে সাহস করবে না।

* একটি বিশেষ দলীয় লোকজনকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি/প্রো-ভিসিসহ জনবল নিয়োগ করায় দেশের জনগণ হতাশ হয়েছে। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে সৃষ্ট সরকার কর্তৃক এসব নিয়োগে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ ব্যক্তিবর্গকে অগ্রাধিকার প্রদান করার দাবি জানানো হয়।

* সকল নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপ করে দেশের বৈপ্লবিক পরিবর্তন ও কার্যকর সংস্কার করার মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার আহ্বান।

* বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান বর্তমান সরকারকে যে ১৮ মাস সময় দেওয়ার কথা বলেছেন, আমরা তা সমর্থন করছি। দেশে সংস্কারে পর্যাপ্ত সময় প্রয়োজন।

* বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন সৃষ্ট ছাত্র-জনতার বিজয়কে কোন রাজনৈতিক গোষ্ঠি কুক্ষিগত করে দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা যেন না হয়, এজন্য সরকারের উপদেষ্টা, ছাত্র-জনতাসহ সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান। দেড় সহাস্রাধিক শহীদ, তিন সহস্রাধিক অন্ধত্ব-পঙ্গুত্ব ও দশ সহস্রাধিক আহতের বিনিময়ে প্রাপ্ত বিজয়ের মূল লক্ষ্য বৈষম্যমুক্ত সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে দেশের সর্বস্তরের মানুষকে নিরলস কাজ করে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়। নেতৃবৃন্দ বলেন, অন্তর্বতীকালীন সরকারকে দাবি-দাওয়া দিয়ে বিব্রত করতে চাই না। আমরা তাদের সহযোগিতা করতে চাই। প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য সময় দিতে চাই। আমরা মনে করি, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সৃষ্ট নতুন বাংলাদেশ হবে দুর্নীতি ও বৈষম্যমুক্ত।

বৈঠকে নেতৃবৃন্দ- সব রাজনৈতিক দলের সাথে সমন্বয় করে দেশের প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে অবাধ, সুষ্ঠ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহবান জানান।

গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনা করেন, কবি মাহমুদুল হাসান নিজামী, জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য খাজা হাসান আলী, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট নেতা পীরজাদা গোলামুর রহমান আশরাফ শাহ, এডভোকেট আবু নাছের তালুকদার, মুহাম্মদ সোলায়মান ফরিদ, সৈয়দ মোজাফফর আহমদ মোজাদ্দেদী, শাহজালাল আহমদ আখঞ্জী, পীর কাজী ছাদেকুরর রহমান হাশেমী, এডভোকেট মুহাম্মদ ইকবাল হাসান, বাংলাদেশ ইসলামী যুবসেনা কেন্দ্রীয় পরিষদের সভাপতি মুহাম্মদ আকতার হোসেন চৌধুরী, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন ও শাহেদুল আলম প্রমুখ।

     আরো দেখুন:

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০  

You cannot copy content of this page