এম.এইচ মনির।।
২০২১ সাল নানা ঘটনায় দেশ বিদেশে আলোচিত হয়েছে কুমিল্লা। সবছেয়ে বেশি আলোচিত ঘটনা ছিল কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের নান্দনিক অফিস উদ্বোধনকালে ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে ‘কুমিল্লা বিভাগ’ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এমপি বাহারের ‘মধুর’ বাহাস! দেশে-বিদেশে ঝড় তোলে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘আপা’ সম্বোধন করে ভাইয়ের দাবি নিয়ে এমপি বাহার তুলে ধরেন কুমিল্লাবাসীর মনের কথা।
প্রধানমন্ত্রীর সাথে একজন তৃণমুল নেতার শ্রদ্ধা-ভালোবাসার সম্পর্ক প্রত্যক্ষ করে পুরো দেশবাসী। মূহুর্তে ভাইরাল হয় কথোপকথোনের ভিডিও। রাজনৈতিক অঙ্গনের ঘটনা প্রশংসিত হয়েছে সর্বমহলে। সাহসী নেতা এমপি বাহার।
এছাড়া কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের ৩ বর্ষিয়ান নেতা এড. আবদুল মতিন খসরু, অধ্যক্ষ আফজল খান এডভোকেট, অধ্যাপক আলী আশ্রাফ ও বিএনপির সাবেক এমপি অধ্যক্ষ মো. ইউনুছকে হারিয়েছেন ২০২১ সালে। বছজুড়ে নানা রাজনৈতিক ঘটনায় আলোচনায় এসেছে কুমিল্লা।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এমপি বাহারের ‘মধুর’ বাহাস! :
২১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে কুমিল্লাকে বিভাগ ঘোষণার দাবি জানান কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আ. ক. ম. বাহাউদ্দিন বাহার। কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয় উদ্বোধনী উপলক্ষে এই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালি যুক্ত হন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংসদ সদস্য বাহার ‘মধুর’ বাহাসে জড়িয়ে পড়েন।
গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। অপরদিকে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যালয় থেকে নেতাকর্মীরা যোগদান করেন।
অনুষ্ঠানের শেষ দিকে কুমিল্লা বিভাগ চেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আবেদন জানিয়ে আ. ক. ম. বাহাউদ্দিন বাহার বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, কুমিল্লাতে কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর দীর্ঘ জীবন কাটিয়েছেন। তিনি কুমিল্লার জামাতা ছিলেন। একশ বছর আগে এ কুমিল্লা রাজধানী ছিলো। আমি ১৯৮৮ সাল থেকে বিভাগের আন্দোলন করি। আমি বিভাগের আন্দোলন করেছি কিন্তু বিভাগ হয়েছে ফরিদপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেটে। অথচ আমি একমাত্র সংসদ সদস্য, যে সংসদে দাঁড়িয়ে বিভাগের বিষয়ে কথা বলেছি। কিন্তু আমার এলাকা কুমিল্লা বিভাগ হয়নি। আজকের এ সুন্দর একটি দিনে আপনার কাছে আবেদন করছি। এদিন আমরা আর কখনো পাব না। এ সুন্দর দিন আমরা মনে রাখব। ৬০ লাখ মানুষের প্রাণের দাবি কুমিল্লাকে বিভাগ ঘোষণা করা হোক।’
এ সময় প্রতিউত্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিভাগের বিষয়ে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি দুটি বিভাগ বানাব দুটি নদীর নামে। একটি হবে পদ্মা, অপরটি মেঘনা। এ দুই নামে বিভাগ করতে চাই।’
এ সময় আ. ক. ম. বাহাউদ্দিন বাহার বলেন, ‘আপা, আমি একটি কথা বলতে চাই।’
এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুচকি হেসে বলেন, ‘হুম, বলো।’
আ. ক. ম. বাহাউদ্দিন বাহার বলেন, ‘আপা, কুমিল্লা নামে দেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “না, আমি এ ‘কু’ নামে দিব না।”
জবাব বাহার বলেন, ‘না আপা, কুমিল্লা নামে দেন।’
জবাবে প্রধানমন্ত্রী আবারও বলেন, ‘আমি তোমার কুমিল্লার নামে দিব না। কারণ, তোমার কুমিল্লা নামের সঙ্গে খুনি মোসতাকের নাম জড়িত।’
আ. ক. ম. বাহার আবারও বলেন, ‘না আপা, কুমিল্লা নামে দেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নো, আমি কুমিল্লার নামে দিব না। কুমিল্লার নাম নিলেই মোসতাকের নাম উঠে।’
আ. ক. ম. বাহাউদ্দিন বাহার আবারও বলেন, ‘আপা, কোনো কুলাঙ্গারের নামে দেশের পরিচয় হয় না। বাংলাদেশের পরিচয় বঙ্গবন্ধুর ওপর, মোনায়েম খানের ওপর না। যখন বাংলাদেশের নাম ছিলো না, তখন সবাই বঙ্গবন্ধুর দেশ নামে বলত। কোনো কুলাঙ্গারের নামে পরিচিত না।’
এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাহার থামো, আমি যদি কুমিল্লার নামে দিই তাহলে চাঁদপুর বলবে তাদের নামে, নোয়াখালী বলবে তাদের নামে দেওয়ার জন্য। কুমিল্লা তো ত্রিপুরার একটি ভগ্নাংশ।’
জবাবে আ. ক. ম. বাহাউদ্দিন বাহার বলেন, ‘আপা ময়মনসিংহ, সিলেট, রংপুর সবাইকে তাদের নামে দিয়েছেন এতে কোথাও কোনো সমস্যা হয়নি।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “ফরিদপুর বিভাগ করব ‘পদ্মা’ নামে। ফরিদপুরের নামও দিচ্ছি না। আর কুমিল্লা বিভাগ হবে ‘মেঘনা’ নামে। কারণ ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’- এ শ্লোগান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ করেছে বিজয় অর্জন করেছে।”
আ. ক. ম. বাহাউদ্দিন বাহার বলেন, ‘না আপা, আমাদেরটা কুমিল্লার নামে রাখেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এ নামে অন্য জেলাগুলো আসতে চায় না।’
আ. ক. ম. বাহাউদ্দিন বলেন, ‘কেন আসবে না?’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘নোয়াখালী, ফেনী, চাঁদপুর, লক্ষীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া কেউ আসবে না।’
আ. ক. ম. বাহার আবারও বলেন, ‘আপা আপনি কী সিলেটে জিজ্ঞাসা করে বিভাগ দিয়েছেন। আপনি দিলে সবাই আসবে, সবাই মানবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘নো, তোমাকে দায়িত্ব দিলাম; তুমি রাজি করিয়ে নিয়ে আস। সবাইর কাছ থেকে লিখিত নিয়ে আস।’
আ. ক. ম. বাহার বলেন, ‘আপা, আপনি বলে দিলে সবাই মানবে। আমার কথা কেউ শুনবে না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “পদ্মা, মেঘনা, যমুনা নাম দিয়ে দিচ্ছি। তোমরা ছাত্র আবস্থায় শ্লোগান দিয়েছ- ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার-আমার ঠিকানা; বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’।”
আ. ক. ম. বাহাউদ্দিন বাহার বলেন, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। বীর মুক্তিযোদ্ধা আমরাই প্রথম বলেছিলাম। আমরা বঙ্গবন্ধুর কর্মী।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাসতে হাসতে বলেন, “তাহলে তুমি থাকো। যদি বিভাগ চাও তাহলে আমি ‘মেঘনা’ নামে করে দিতে পারি।”
নাছোড়বান্দা আ. ক. ম. বাহাউদ্দিন বাহার বলেন, ‘আপা করজোড়ে অনুরোধ করছি, কুমিল্লা নামে দেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মেঘনা পার হলেই তো কুমিল্লা, আর পদ্মা পার হয়ে যাবো ফরিদপুর।’
আ. ক. ম. বাহাউদ্দিন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়; আপা হিসেবে আপনার কাছে দাবি জানাচ্ছি; বঙ্গবন্ধুকন্যা আমাদের ফেরত দিবে না। বঙ্গবন্ধুকন্যা আমাদের ফেরত দিতে পারবে না।’
এ সময় নেতাকর্মীরা করতালি দিতে থাকেন।
তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘তোমার পদ্মা সেতু, মেঘনা সেতু, গোমতি, তিতাস সেতু করে দিয়েছি। সবই তো করলাম। আমি তো বললাম কেউ আসবে না।’
আ. ক. ম. বাহার বলেন, ‘আপা আপনি চাইলে বাংলাদেশে হবে না এমন কিছুই নাই। আপনি চাইলে সবই হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নোয়াখালী চায় তাদের নামে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া চায় তাদের নামে, সবাই সবাইর নামে চায় এটা দিতে পারব না। চাঁদপুর নাম তো আরও সুন্দর। চাঁদপুর চায় তাদের নামে হোক।’
আ. ক. ম. বাহার বলেন, ‘আপা বঙ্গবন্ধুর আমলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছিল পার্ট অব কুমিল্লা, চাঁদপুর ছিল পার্ট অব কুমিল্লা। আমাদের ছাত্রলীগের বিশাল একটি অংশ ছিল কুমিল্লার।’
জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কুমিল্লার আসল নাম ছিল ত্রিপুরা। এখনো পুরনো কাগজে ত্রিপুরা লেখা আছে। রেজিস্ট্রার দপ্তরে গিয়ে দেখ ত্রিপুরাই লেখা আছে। ঠিক আছে, তোমাদের প্রস্তাব রাখলাম। পছন্দ হলে ভাল, না হলে কিছু করার নেই।’
জবাবে আ. ক. ম. বাহাউদ্দিন বাহার বলেন, ‘আপা আপনি এভাবে বললে আমরা কার কাছে যাব।’
জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘ঐতিহাসিক দুটি নদীর নামে দিচ্ছি। এ নিয়ে আর কোনো কথা নয়। তবে তোমাদের প্রস্তাব রাখলাম।’
বিদায় নিলেন ৪ বর্ষিয়ান নেতা
বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কুমিল্লা-৫ (বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া) আসনের সাংসদ সাবেক মন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু ১৪ এপ্রিল ইন্তেকাল করেন। এ আসনের সাবেক সাংসদ অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুস মারা গেছেন ২৭ মার্চ। ৩০ জুলাই চান্দিনা আসনের সাংসদ অধ্যাপক আলী আশ্রাফ মারা যান। ২৭ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও আওয়ামীলীগের উপদেষ্ঠা কমিটির সদস্য আবদুল বাসেত মজুমদার মারা গেছেন। ১৬ নভেম্বর কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ আফজল খান এডভোকেট মারা গেছেন। এ ৪ বর্ষীয়ান নেতার প্রয়ান রাজনৈতিক অঙ্গনের আলোচিত ঘটনা।
আরো দেখুন:You cannot copy content of this page