স্টাফ রিপোর্টার।।
বাংলাদেশ বিমানে কর্মরত ১৫ জন নারী ককপিট ক্রুর মধ্যে ৯ জনই অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বৈষম্যমূলক আচরণের ব্যাপারে। বিশেষ করে প্রশিক্ষণ এবং কর্মসময়ে নারীদের ওপর একপ্রকার বিদ্বেষ, নাজেহাল করাসহ যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। সবচেয়ে বেশি অভিযোগের তীর শিডিউল অফিসার ক্যাপ্টেন শাহাদাতের দিকে।
এক গোপন প্রতিবেদনে ৯ জন নারী ককপিট ক্রুর অভিযোগ উঠে আসে বিমানের ফ্লাইট নিরাপত্তার ঊর্ধ্বতন প্রধান কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ছাড়াও বেসামরিক এভিয়েশন কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও আছে অভিযোগ।
বাংলাদেশ বিমানে জাতীয় পতাকা ধারণকারী ৫ জন ক্যাপ্টেন আছেন। রয়েছেন ১০ জন নারী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তারাও জাতীয় পতাকাবাহী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন নারী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন।
তিনি দুঃখের সঙ্গে জানান, তার ভীষণ জ্বর হয়েছিল। তিনি আকাশে উড়তে সক্ষম নন বলে জানান। কিন্তু বিমানের মেডিকেল অফিসার সুপারিশ করেন রোগ পরীক্ষা করে প্রাসঙ্গিক ওষুধ সেবন করতে। পিসিআরে কোভিড-১৯ পরীক্ষার পর করোনা শনাক্ত হলে তার বিশ্রামের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তাকে দায়িত্ব পালনে বাধ্য করা হয়। উল্টো বিমানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সতর্ক করে বলেন- সে যদি তার দায়িত্ব পালন না করে তাহলে পদোন্নতি আটকে দেওয়া হবে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে অভিযোগও পেশ করা হবে। শুধু তাই নয় তার সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার এবং পেশাবহির্ভূত আচরণ করতেও দ্বিধা করা হয়নি। তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ারও হুমকি দেওয়া হয়। সংগত কারণে অসুস্থ নারী ককপিট ক্রুর বিমানে উড়তে হয় শরীরের পানিশূন্যতা নিয়ে। কোনো একপর্যায়ে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান- বিমান তখন রানওয়ের বাইরে। ফিরতি কোনো বিমানে ফ্লাই করাও সম্ভব ছিল না। পরে ঢাকা থেকে অন্য ককপিট ক্রু পাঠানো হলে তার পক্ষে বিমানে ওড়া সম্ভব হয়।
সংশ্লিষ্ট নারী ক্রু অভিযোগ করে বলেন, ‘তিনি যদি বিমান চলার সময় সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়তেন তাহলে এত যাত্রীর জীবন বিপন্ন করার দায়ভার কার ওপর বর্তাত। নিজেরও তো বাঁচার পথ থাকত না।’
সবচেয়ে বেশি অভিযোগ যার বিরুদ্ধে
বিমানের শিডিউইল অফিসার ক্যাপ্টেন শাহাদাত হোসেন, যিনি এস হোসেন নামে পরিচিত, তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ উঠেছে। এস হোসেনের বিরুদ্ধে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও যৌন হয়রানিরও অভিযোগ করেছেন নাম প্রকাশে অচ্ছিুক একাধিক ক্রু। তার বিরুদ্ধে মৌখিক নিপীড়ন ছাড়াও অশ্লীল ইঙ্গিত এমনকি যৌন হয়রানির মতো অভিযোগও আনা হয়েছে।
একাধিক যাত্রীর বরাতে জানা গেছে, শাহদাত ফ্লাইট চলাকালে প্রায় পুরোটা সময় ককপিটের বাইরে কেবিন ক্রুদের সঙ্গে থাকেন আর টয়লেট ব্যবহার করেন। যাত্রার পুরোটা সময় তাকে কেবিন ক্রুদের উত্ত্যক্ত করতে এবং পাইলটদের অন্যায় কাজ করতে বাধ্য করেন। এর বাইরে তার বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতিরও অভিযোগ রয়েছে। তার বন্ধুবান্ধব ও ব্যাচমেট এবং কাছের মানুষদের সবসময় নিয়মের তোয়াক্কা না করে সেরা সুবিধা পাইয়ে দেন। এর আগেও শাহদাতের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির বিষয়ে পুলিশে পর্যন্ত অভিযোগ দায়ের হয়েছিল। কিন্তু এমডির ভাই পরিচয় আর রিপোর্টিং বস হওয়ার কারণে শাহদাতের এমন ব্যবহারের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারছেন না ক্রুরা।
শাহদাত নিজেকে কখনো এমডির আপন ভাই, কখনো কাজিন পরিচয় দিয়ে বেড়ান। তার বিরুদ্ধে একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে বিমানে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ আত্মসাতেরও অভিযোগ রয়েছে। বিমানে কর্মরতদের কেউ শাহাদাতের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেলেই এমডির ভয় দেখিয়ে তাকে চাকরিচ্যুত করার হুমকি দেন। এর আগেও অনেকের বিধিবদ্ধ প্রমোশন আটকে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে শাহাদাতের বিরুদ্ধে। শাহাদাতের অদৃশ্য খুঁটির জোরে তার বিরুদ্ধে কেউই মুখ খুলতে রাজি হচ্ছেন না।
এর বাইরে মাতৃত্বকালীন ছুটির ব্যাপারেও নারী পাইলটদের ওপর অসদাচরণ করা হয় বলে জানা গেছে। নারী প্রধান কর্মকর্তা বিমানের মধ্যেই পুরুষ পাইলটের দ্বারা নিগৃহীত হওয়ার দুঃসহ চিত্রও জানা যায়। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো নারী ক্রুরা পদস্থদের এ ধরনের অভিযোগ করার পর উল্টো তাদেরই কারণ দর্শানোর নোটিশ পেতে হয়। ফলে অকথ্য নির্যাতন মুখ বুজে সইতে হচ্ছে তাদের।
অভিযোগকারীরা বলেন, ইচ্ছাকৃত বৈষম্য, হয়রানি, নিয়মিত গালিগালাজ, পদোন্নতি ও প্রশিক্ষণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে কাজের পরিবেশ প্রতিকূল হয়ে পড়েছে। এটি নারী ককপিট ক্রু সদস্যদের প্রচণ্ড চাপের মধ্যে ফেলেছে এবং কেউ কেউ এমনকি বিমান ছেড়েও দিয়েছেন। ওই ৯ জনের প্রথম গ্রুপ রিপোর্ট ‘নারী ককপিট ক্রু হয়রানি সংক্রান্ত গোপনীয় প্রতিবেদন’ বিমানের ফ্লাইট সেফটি, অন্যান্য কর্মকর্তাদের এবং বিমানের প্রধানকে দেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানের একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অভিযোগের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তবে বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর হওয়ায় তারা কেউ এখনই মুখ খুলতে রাজি হননি।
আরো দেখুন:You cannot copy content of this page