নিউজ ডেস্ক।।
অনলাইনভিত্তিক এমটিএফই অ্যাপে বিনিয়োগ করলে ডলারের বিপরীতে আসবে নির্দিষ্ট পরিমাণ লভ্যাংশ। পরিশ্রম ছাড়াই রাতারাতি ধনী হওয়ার স্বপ্নে এক শ্রেণির লোকজন অ্যাপটিতে বিনিয়োগ শুরু করেন। অতি মুনাফার লোভে এতে বিনিয়োগ করে অন্তত ১২ কোটি টাকা হারিয়েছেন জয়পুরহাটের হাজারো যুবক।
মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপ (এমটিএফই) দুবাইভিত্তিক একটি অনলাইন প্রতিষ্ঠান। এটি অনলাইনে ডেসটিনির মতো এমএলএম ব্যবসা শুরু করেছিল। সারাদেশে এই প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর ও সিইও নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। বাদ যায়নি জয়পুরহাটও।
জেলার একাধিক ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, অ্যাপটির স্থানীয় এজেন্ট নিজেকে সিইও বলে পরিচয় দিতেন। এমটিএফইতে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে অনেক ধরনের তৎপরতা চালিয়েছেন। শহরের নামীদামি হোটেল-রেস্তোরাঁয় সভা-সেমিনারের আয়োজন করে আকর্ষণীয় লাভের প্রলোভন দেখানো হতো। এসব অনুষ্ঠানে গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকতেন। অফিস ভাড়া করেই চলতো এই কার্যক্রম। পৌর শহরের ইরাকনগর এলাকার সাদ আলম চৌধুরী এই কার্যক্রমের নেতৃত্ব দিতেন। জয়পুরহাট সরকারি কলেজের অনার্সের শিক্ষার্থী সাদ আলম চৌধুরী নিজেকে পরিচয় দিতেন এমটিএফইর জয়পুরহাটের সিইও। সাদ ও তার সহযোগীদের বিশ্বাস করে অনেকে ব্যাংক-এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে, কেউ ভিটামাটি বিক্রি-বন্ধক রেখে, গরু-ছাগল ও সোনার গয়না বিক্রি করে বিনিয়োগ করেন। গত কয়েকদিন ধরে বিনিয়োগকারীরা লভ্যাংশ পাচ্ছেন না। এরই মধ্যে এমটিএফই অ্যাপে প্রতারণার ঘটনা জানাজানির পর গা-ঢাকা দিয়েছেন সিইও সাদ চৌধুরী।
একাধিক ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সর্বনিম্ন ২৬ ডলার বিনিয়োগ করে এমটিএফইতে অ্যাকাউন্ট খোলা যেতো। অ্যাকাউন্ট খোলার পর বিনোয়াগ করা টাকার ওপর নির্দিষ্ট পরিমাণ লভ্যাংশ জমা হতো। যিনি যত বেশি বিনিয়োগ করবেন, তিনি তত বেশি ডলারের বিপরীতে লভ্যাংশের টাকা পাবেন বলা হয়েছিল। সাদ চৌধুরী, তামান্না আখতার, সুমন খন্দকার, ময়নুল হোসেন, আল আমিন হোসেন জয়পুরহাটের সিইও এবং প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন। তারা অ্যাকাউন্ট খুলে দিলে কোম্পানি থেকে কমিশন পেতেন।
জেলা শহরের বাসিন্দা সৌখিন, কাউছার ও আল আমিন জানিয়েছেন, কেউ এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে, কেউ জমি বন্ধক ও গরু-ছাগল বিক্রি করে বিনিয়োগ করেছেন। এরপর থেকে ডলারের বিপরীতে লভ্যাংশের টাকা পাচ্ছিলেন। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে এমটিএফই অ্যাপ বন্ধ। তারা লভ্যাংশের টাকা পাচ্ছেন না। স্থানীয় প্রতিনিধিরা আত্মগোপনে চলে গেছেন। এ ঘটনায় আইনের আশ্রয় নেওয়ার কথা জানালেন তারা।
জেলা শহরের বাসিন্দা মাছুম হোসেন বলেন, ‘আমি এক দোকানে কাজ করি। আমরা বয়সী অনেককে ঘরে বসে এমটিএফইতে বিনিয়োগ করে আয় করতে দেখেছি। তাদের দেখে এক মাস আগে বাড়ির জমিজমা বন্ধক রেখে তিন লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম, এখন আমার সব শেষ। কী করবো, কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। কীভাবে বাড়ির জমিজমা ছাড়াবো, কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছি না।’
জয়পুরহাট সরকারি কলেজের অনার্সের দুই শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানালেন, মেসে থেকে পড়াশোনা করি। বাবা-মাকে বলেছিলাম, দুই লাখ টাকা দিলে এমটিএফই অ্যাপে বিনিয়োগ করে নিজেরাই খরচ চালাতে পারবো। অনেক ভেবেচিন্তে মা-বাবা টাকা দিলেন। কিছু টাকাও পেয়েছিলাম। এখন সব টাকা নিয়ে গেলো তারা। লজ্জায় কাউকে বিষয়টি জানাতেও পারছি না।
সাদ আলম চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ দুই সহযোগী জানিয়েছেন, জেলার হাজার হাজার মানুষ প্রতারিত হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে বিনিয়োগকারীরা লাভের টাকা পাচ্ছেন না। আবার বিনিয়োগের অর্থও ফেরত পাচ্ছেন না। জেলা থেকে ১২ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করা হয়েছিল। বিনিয়োগকারীদের বেশিরভাগ নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য। ঘটনার পর থেকে গা-ঢাকা দিয়েছেন সাদ চৌধুরী। তারাও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
এরই মধ্যে গত ২০ আগস্ট রাতে প্রতারণার অভিযোগে সাদ আলম চৌধুরীর বিরুদ্ধে জয়পুরহাট সদর থানায় একটি অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী কয়েকজন যুবক। প্রতারণার শিকার পাঁচ বিনিয়োগকারীর পক্ষে অভিযোগটি দেন সদর উপজেলার দেওয়ানপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ইমন হোসেন।
লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, জয়পুরহাট শহরের ইরাকনগরের বাসিন্দা সাদ আলম চৌধুরী সবুজনগরে জাকস ফাউন্ডেশনের পাশে এমটিএফইর অফিস খোলেন। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সরাসরি সভা-সেমিনারে ডেকে নিয়ে অ্যাপে বিনিয়োগ, বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে কোম্পানির শেয়ার কেনার কথা বলে ইমনের কাছ থেকে ৬৩ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এখন তার অফিস তালাবদ্ধ। সাদ চৌধুরী পলাতক। তার সহযোগীরাও পালিয়ে গেছেন। এই অভিযোগে আরও চার জন ভুক্তভোগীর নাম রয়েছে। তাদের কাছ থেকে মোট এক লাখ ২৫ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
ইমন হোসেন জানিয়েছেন, সাদ আলম চৌধুরীর আরও ১২ জন সহযোগী রয়েছেন। তারা জেলা শহরের নামীদামি হোটেল-রেস্তোরাঁয় সভা-সেমিনার করে এমটিএফই অ্যাপে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করেন তাদের। এসব সভা-সেমিনারে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা থাকতেন। এ কারণে আস্থা পেয়েছিলেন সবাই। এরপর বিনিয়োগ করেছিলেন। এভাবে প্রতারিত হবেন, কখনও ভাবেননি তারা।
মঙ্গলবার বিকালে পৌর শহরের ইরাকনগর মহল্লায় সাদ আলম চৌধুরীদের বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তার মা রেজিয়া সুলতানা জানিয়েছেন, এক সপ্তাহ আগে বাড়ি থেকে চলে গেছেন সাদ। এর মধ্যে ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। মোবাইল নম্বর বন্ধ থাকায় ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না তিনি।
জয়পুরহাটের সমাজকর্মী তিতাস মোস্তফা বলেন, ‘এখন পর্যন্ত জেনেছি, জেলা থেকে ১২ কোটি টাকা লোপাট করেছে এমটিএফই। এই কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে ক্রিপ্টো কারেন্সির মাধ্যমে অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার স্বপ্নে সর্বস্বান্ত হয়েছেন জেলার হাজারো যুবক।’
বারবার ঠকেও আমরা শিক্ষাগ্রহণ করি না উল্লেখ করে তিতাস মোস্তফা বলেন, ‘অতীতে ডেসটিনি, আইটিসিএল, যুবক, ইভ্যালি থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত ছিল আমাদের। আমরা অতীত থেকে শিক্ষা নিইনি বলে বারবার প্রতারিত হচ্ছি। তারা যুবসমাজকে টার্গেট করেছে। ফলে একেক সময়ে একেক নামে কোম্পানি আসছে। অভিভাবকরা মনে করছেন, তাদের সন্তানেরা রাতারাতি ধনী হবে। আমরা যদি বেকারমুক্ত দেশ গড়তে পারতাম, তাহলে এমন সমস্যা থাকতো না। আজকে এই প্রতিষ্ঠান পালিয়েছে, এমন আরও প্রতিষ্ঠান আছে, হয়তো তারাও পালাবে। প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়। প্রশাসন যদি কঠোর ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জয়পুরহাটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নূরে আলম বলেন, ‘এমটিএফই অ্যাপ ব্যবহার করে অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার অভিযোগে গত রবিবার রাতে একটি অভিযোগ পেয়েছি আমরা। এটির তদন্ত চলছে। এখানে যারা জড়িত তাদের ব্যাপারে খোঁজ নিচ্ছি। তবে কাউকে আটক করা হয়নি।’
আরো দেখুন:You cannot copy content of this page