নিউজ ডেস্ক।।
“হামিদুর বেঁচে নেই এখনো বিশ্বাস হয় না। তার কথা মনে পড়লে নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। সন্ধ্যার পর ছুটে যাই কবরস্থানে। ছেলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলি দীর্ঘসময়। মৃত্যুর আগে তাকে যে কথা বলা হয়নি, সব কথা বলতে থাকি। জানি না ছেলে সব কথা শুনে কিনা। সে রুটি খুব পছন্দ করতো। ছেলে নেই বলে গত এক বছর বাসায় রুটি বানাইনি।” — কথাগুলো বলছিলেন কুমিল্লার গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হামিদুর রহমান সাদমানের মা কাজী শারমিন আক্তার। কান্নাজড়িত কণ্ঠে কুমিল্লা নগরীর রাজাগঞ্জ এলাকার নিজ বাসায় তিনি এ প্রতিবেদককে এসব কথা বলেন।
গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের খবরে রাজধানীর শাহবাগে বিজয় মিছিলে যোগ দিতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান হামিদুর। কেরানীগঞ্জ থেকে মিছিল নিয়ে যাওয়ার পথে বংশাল থানার সামনে পুলিশের বাধার মুখে পড়ে ছাত্র-জনতা। এ সময় পুলিশের গুলিতে তার বুক ঝাঁজরা হয়ে যায়। বিকেল ৫টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
শহীদের তালিকায় হামিদুর
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় ২০২৫ সালের ১৫ জানুয়ারি “জুলাই অভ্যুত্থান” চলাকালীন শহীদ হওয়া ৮৩৪ জনের যে তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করে, সেখানে ৬২৩ নম্বরে রয়েছে হামিদুর রহমান সাদমানের নাম। তার মেডিকেল কেস আইডি ২২৭৪১।
হামিদুর রহমান কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার চৌয়ারা ইউনিয়নের দিঘলগাঁও মজুমদার বাড়ির বাসিন্দা ও বাহরাইন প্রবাসী ইকবাল মজুমদারের ছেলে। কুমিল্লা সিসিএন পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে ২০২৪ সালের জুন মাসে ঢাকায় ইন্টার্ন করতে যান তিনি।
বিচার না পাওয়ার ক্ষোভ
শহীদ হামিদুরের মা বলেন, “ছেলের হত্যার ঘটনায় গত ৯ সেপ্টেম্বর বংশাল থানায় একটি হত্যা মামলা করি আমি নিজেই বাদী হয়ে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছেলের রক্তমাখা গেঞ্জি ও প্যান্ট নিয়ে গেছেন। এরপর আর কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। এরপর গত ২ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও মামলা করেছি। কিন্তু মৃত্যুর ১১ মাস পেরিয়ে গেলেও বিচার তো দূরের কথা, বিচারকার্য শুরুই হয়নি। আমার ছেলে দেশের জন্য শহীদ হয়েছে। তার খুনিদের ফাঁসি চাই।”
তিনি আরও বলেন, “আন্দোলনে অংশ নেওয়ার আগেও ওর অনেক স্বপ্ন ছিল। আমি তাকে সাহস জুগিয়েছি, কারণ আবু সাঈদের মৃত্যুর পর হাসিনার সরকারের প্রতি আমার ঘৃণা বেড়ে যায়। এরপর ছেলেদের বলেছি, ভয় পেও না, স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন থামানো যাবে না।”
মায়ের স্মৃতিচারণ ও ভাইয়ের চোখের জল
শহীদ হামিদুরের ছোট ভাই, এইচএসসি পরীক্ষার্থী আশরাফুল আমিন সাফি বলেন, “আম্মু সারাদিন ভাইয়ের ছবি নিয়ে কাঁদেন। ভাইয়া ঢাকায় যাওয়ার সময় আমার নতুন গামছা চেয়ে নেয়। আমি রাগ করলেও শেষে দিয়ে দেই। কিন্তু ভাইয়া নেননি। ভাইয়ার মৃত্যুর পর সেই গামছাই মাথার নিচে দেওয়া হয়। সেটা রক্তে ভিজে যায়। সেই দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে। মনে হয়, ভাইয়া আজো পাশেই আছে।”
‘আমার ছেলেকে গুলি করেছে যারা, তাদের বিচার চাই’
মা কাজী শারমিন বলেন, “একজন মা হিসেবে শুধু আমার ছেলের নয়, যারা এই আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছে, তাদের সবার জন্যই বিচার চাই। এই স্বৈরাচার সরকারকে ক্ষমতায় রেখে এদেশে কখনো শান্তি আসবে না। আর যেন কোনো মা তার বুকের ধনকে হারায় না, এই প্রত্যাশায় সকলের কাছে বিচার চাই।”
সূত্র- জাগো নিউজ