কুবির শিক্ষককে মারতে তেড়ে আসা ডেপুটি রেজিস্ট্রারকে ওএসডি

ফয়সাল মিয়া, কুবি।।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) নথি জালিয়াতি, একাধিক শিক্ষককে মারতে তেড়ে যাওয়া, সহকর্মী ও কর্মচারীদের সাথে অসদাচরণ, হেনস্তা ও গালমন্দ, জামাত-শিবির ট্যাগ লাগিয়ে হয়রানি, বিভিন্ন নিয়োগ ও টেন্ডার বাণিজ্যের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে ডেপুটি রেজিস্ট্রার জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে।

সর্বশেষ উপাচার্যের কক্ষে শিক্ষকদের থাপড়িয়ে দাঁত ফেলে দেওয়ার হুমকি প্রদান করে উপাচার্যপন্থী এই কর্মকর্তা। এতসব অভিযোগ থাকার পরও প্রশাসনের নির্লিপ্ততায় দিন দিন বেপরোয়া হচ্ছেন তিনি। সর্বশেষ গত ৫ জুন ৯৫ তম সিন্ডিকেট সভায় তাকে ওএসডি (যাদের বেতন ভাতা সবই আছে, কিন্তু বসার স্থান নাই, দায়িত্ব নাই, কাজ নাই, নাই কোন গুরুত্ব। মোটকথা ওএসডি কর্মকর্তার কোন দাপ্তরিক কাজ বা চেয়ার নেই) করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জাকিরের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ও বেপরোয়া ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। জ্যেষ্ঠ শিক্ষক ও কর্মকর্তারা মনে করেন, এই কর্মকর্তার বেপরোয়া আচরণে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় দিনদিন অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারী উপাচার্যের কক্ষে শিক্ষক সমিতির নবনির্বাচিত নেতাদের থাপড়িয়ে দাঁত ফেলে ফেলে দেওয়ার হুমকি প্রদান করেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষক সমিতির নবনির্বাচিত সভাপতি অধ্যাপক ড. আবু তাহের ও সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন।

২০২২ সালে জাকিরের দ্বারা ইংরেজি বিভাগের আরেক শিক্ষক অপমানিত ও হেনস্তা হয়। একই বছরের জানুয়ারি মাসে জাকিরের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের কক্ষে তালা দিয়ে তৎকালীন রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. আবু তাহেরকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। পরবর্তীতে অধ্যাপক তাহের দায়িত্ব পালনে অস্বস্তিবোধ করছেন বলে ঐ পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

২০১৪ সালে নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আবদুর রহমানকে শারীরিক ভাবে লাঞ্ছিত করেন জাকির। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হলে বিষয়টি পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১ তম সিন্ডিকেটে উঠে। সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভবিষ্যতে বেপরোয়া আচরণ করলে চাকরিচ্যুতিসহ জাকিরের বিরুদ্ধে যেকোনো সিদ্ধান্ত প্রশাসন নিতে পারবে বলে জানা যায়।

২০১৩ সালে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। অভিযোগ রয়েছে, তিনি নিয়োগ পরীক্ষায় ফেল করা প্রার্থী ছিলেন। নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই স্থানীয় ক্ষমতা দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাব বিস্তার করে একে একে সবার সাথেই অসদাচরণ শুরু করেন। জাকির নিজেকে কখনো সাবেক অর্থমন্ত্রীর অনুসারী, কখনো সাবেক রেলমন্ত্রীর অনুসারী, আবার কখনো কুমিল্লা সদর আসনের এমপি হাজী বাহারের অনুসারী বলে পরিচয় দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাব বিস্তার করেন। এভাবে প্রভাব বিস্তার করে সাবেক উপাচার্য আলী আশরাফের সময়ে জাকির তার দুবাই ফেরত ভাই বিল্লালকে উপ-সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। গুঞ্জন রয়েছে জাকির তার বড় বোনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ প্রদানের জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন।

জাকির পূর্বে সার্টিফিকেট বাণিজ্যের সাথেও জড়িত ছিলেন। তার পার্শ্ববর্তী গ্রামে “কাশিপুর টেকনিক্যাল কলেজ” নামে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে সার্টিফিকেট বানিজ্য করতো। দৃশ্যতো কোন কলেজ ছিলো না, কুমিল্লা মহিলা কলেজের সামনে একটি অফিস নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করতো। পরবর্তীতে বিষয়টি প্রকাশ পেলে জাকির সার্টিফিকেট বিক্রির বানিজ্য বন্ধ করে দেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার হয়েও বিলাসবহুল জীবন-যাপন করেন তিনি। হয়েছেন কুমিল্লা ক্লাবের সদস্য। এই ক্লাবের সদস্য হতে গেলে কমপক্ষে ২০ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। এছাড়াও নিজের পাজেরো গাড়িতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা যাওয়া করেন। কুমিল্লা ও ঢাকা মিলিয়ে জাকির বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাটের মালিক। কুমিল্লায় নিজের কেনা বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে জীবন-যাপন করেন।

তাঁর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের দাপ্তরিক কাজ নিয়মিত না করার অভিযোগ রয়েছে। অফিস চলাকালীন সময়ে তিনি টেন্ডার বানিজ্যের উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বিভিন্ন দপ্তরে দপ্তরে ঘুরে বেড়ান। টেন্ডার হাতিয়ে নিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে হাতবদল করেন তিনি।

এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রয়েছে নথি জালিয়াতিরও অভিযোগ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তারা কোন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বা লাভজনক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত থাকতে পারবেন না। তবে সেই নির্দেশনা লঙ্গন করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নথি জালিয়াতি করে ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টাসহ নানা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অভিযোগ অভিযোগ রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২১ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের একটি প্রকল্পের অধীনে নাঙ্গলকোট উপজেলার একটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের কাজ পেতে মেসার্স ল্যান্ডমার্ক বিল্ডার্স, মেসার্স এইচ কবির এন্টারপ্রাইজ নামের ২টি প্রতিষ্ঠানকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি প্রকল্পে কাজ করার অভিজ্ঞতা সনদসহ দরপত্র জমা দেয়। যেখানে ব্যয় দেখানো হয়েছে প্রায় সাড়ে ২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ল্যান্ডমার্ক বিল্ডার্স জাকির হোসেনের স্ত্রী এবং এইচ কবির এন্টারপ্রাইজ তার পরিবারের সদস্যদের নামে রয়েছে বলে জানা যায়। অথচ প্রকৌশল দফতর নিশ্চিত করে এসব প্রকল্পের কোনটিই এই দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান করেনি।

পরে ওই বছরের ২৬ আগস্ট সরকারি সে প্রতিষ্ঠান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দফতরে সত্যতা যাচাইয়ের জন্য চিঠি পাঠানো হয়। তার প্রেক্ষিতে গত ৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. এস.এম. শহিদুল হাসান স্বাক্ষরিত একটি প্রতিবেদনে ‘যাচাইকৃত এবং সঠিক নহে’ উল্লেখ করে অফিসিয়াল মেইল পাঠানো হয়। তবে ১২ সেপ্টেম্বর পুনরায় অফিসিয়াল ডোমেইনযুক্ত মেইল থেকে একই ব্যক্তি স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে ‘যাচাইকৃত এবং সঠিক আছে’ উল্লেখ করে মেইল পাঠানো হয়। দুই রকম মতামত দেওয়ায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের পরিচালক এস এম এনামুল কবির স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে ফের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য অনুরোধ করা হয়। এতে এ জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে।

সরকারি চাকরি করার ফলে জাকির সরাসরি কোন প্রতিষ্ঠানের মালিকানা গ্রহণ না করলেও তার বউ ও মেয়ের নামে একাধিক ঠিকাধারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

তার বড় ভাই হুমায়ূন কবির সংক্ষেপে এইচ কবীর এন্টারপ্রাইজের সাথে মিলিত হয়ে বেশ কিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিকানার সাথে তিনি যুক্ত রয়েছেন। তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান গুলো হলো ল্যান্ডমার্ক পলিটেকনিক ইনস্টিিটউট, ল্যান্ডমার্ক প্যারা-মেডিক ইনস্টিটিউট, কুমিল্লা কৃষি প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, লালমাই পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, কাশিপুর টেকনিক্যাল এন্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ।

এছাড়াও গেল বছরে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স এসোসিয়েশনের নির্বাচনে তিনি সভাপতি পদে নির্বাচন করেন। অভিযোগ রয়েছে, নির্বাচনের আগে জাকিরকে ভোট দেওয়ার জন্য ভোটারদের নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করেন এবং ধর্মগ্রন্থ ছুঁইয়ে শপথ করান। একাধিক ভোটার বিষয়টি প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে মোহাম্মদ জাকির হোসেনকে ফোন দেওয়া হলে তাঁকে পাওয়া যায়নি।

শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান বলেন, তিনি একজন অপেশাদার কর্মকর্তা। এর আগেও তিনি শিক্ষক লাঞ্চিত করেছেন। যার জন্য সিন্ডিকেট থেকে তাঁকে সর্বোচ্চ সতর্কীকরণ করা হয়েছে। ওই সময় যদি তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো তাহলে আজকে এই অবস্থা তৈরি হতো না। গত ১৯শে ফেব্রুয়ারী তিনি উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে শিক্ষকদের থাপড়িয়ে দাঁত ফেলে দেওয়ার হুমকি দিয়ে অশোভন আচরণ করেছেন। এটা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সেদিন তাঁর কারণে শিক্ষকরা অনিরাপদ বোধ করেছেন। শিক্ষকরা থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন। উপাচার্যকে লিখিত দেওয়ার পর তিনি কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় বারবার এমন অবস্থা তৈরি হচ্ছে। আমি মনে করি গত ১৯ ফেব্রুয়ারী উপাচার্য যদি কার্যকর ব্যবস্থা নিতেন তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হতো না। শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার হুমকির মুখে পড়তো না। উপাচার্য যে দীর্ঘসূত্রিতা করেছেন তদন্ত কমিটি গঠনে এগুলো থেকেই বুঝা যায় তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই জাকিরের সাথে সম্পৃক্ত এবং হামলার মদদদাতা। তাঁর সাথে উপাচার্যের কি লেনদেন সেটাও তদন্ত কমিটির খতিয়ে দেখা উচিত এবং সিন্ডিকেটের কাছে আবেদন থাকবে তাঁর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হয়।

সার্বিক বিষয়ে জানতে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈনের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।

     আরো দেখুন:

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০৩১  

You cannot copy content of this page