অধ্যক্ষের সাথে শিক্ষকদের দ্বন্দ্ব চরমে; ফুঁসে উঠেছেন শিক্ষার্থী -অভিভাবকরাও

নিজস্ব প্রতিবেদক।।
কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড সরকারি মডেল কলেজের অধ্যক্ষ ড. এ কে এম এমদাদুল হকের সাথে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছে। অনলাইন ক্লাস ও সরকারি নির্দেশনা ছাড়া অধ্যক্ষের কোন আদেশ কিংবা অফিস অর্ডার শুনছেন না শিক্ষকরা। ২৪ জন শিক্ষকের মধ্যে ২০ শিক্ষক ইতিমধ্যে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা, নারী শিক্ষক ও ছাত্রীদের সাথে অশোভন আচরণের অভিযোগ এনে উর্ধ্বতন কতৃপক্ষের নিকট প্রতিকার চেয়ে অভিযোগ করছেন।তারা বর্তমানে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে রয়েছেন। অধ্যক্ষের পক্ষে রয়েছেন একজন প্রভাষক সহ ৩ শিক্ষক। তারা পরিস্থিতি সামলাতে চেষ্টা তদবির চালিয়েও কুল-কিনারা পাচ্ছেন না। কর্মচারীদের মধ্যেও বিদ্রোহের আবাস পাওয়া গেছে। প্রকাশ্য না হলেও বেশিরভাগ কর্মচারী অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন বলে জানা গেছে। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠাটিতে এক হ-য-ব-র-ল অবস্থা বিরাজ করছে।

ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির সুনাম রক্ষায় নীতিভ্রষ্ট অধ্যক্ষের অপসরণ চেয়ে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা নগরীতে মানববন্ধন করার পর আবারও আন্দোলনে নামছেন। তারা অচিরেই নতুন কর্মসূচি ঘোষনা করতে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। অভিভাবক মহলেও প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ-শিক্ষকদের দ্বন্ধের বিষয়ি টব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে। অধ্যক্ষের নানা অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা, নারী প্রীতি , অপসংস্কৃতি চর্চা সহ নৈতিবাচক বিষয়ে মুখরোচরক আলোচনা বইছে। সবকিছু মিলিয়ে এক বিশৃংখল বিরাজ করছে। সংকট উত্তরণে অধ্যক্ষের দ্রুত অপসরন দাবি করেছেন অভিভাবক সহ কুমিল্লার সচেতন মহল।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় ২ বছর আগে থেকেই অধ্যক্ষের সঙ্গে শিক্ষকদের টানাপোড়ন চলে আসছিল। সম্প্রতি অধ্যক্ষ বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ এনে শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন করার পর থেকেই বিষয়টি অভিভাবক মহলের দৃষ্টিতে আসে। গত ৭ ফেব্রয়ারী নগর উদ্যাণের জামতলায় তিন নদী পরিষদের আয়োজিত অনুষ্ঠানে অংশ নেয় শিক্ষাবোর্ড মডেল সরকারি কলেজ। অনুষ্ঠানে অধ্যক্ষ ও উনার অনুগত মাত্র দুইজন শিক্ষক অংশ নেন। সরকারি নির্দেশনা না থাকায় ২০ শিক্ষক এ অনুষ্ঠান বর্জন করেন। অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ছিল মাত্র ডজনখানেক। শিক্ষকরা আরও জানান, অধ্যক্ষ কলেজে যোগদানের পর বসন্তবরণ উৎসব এর নামে হিন্দিগানের সাথে নৃত্য সহ অপসংস্কৃতি চালান। এবারও এমন উদ্যেগ নিলে আমরা বর্জন করব।

শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, “ ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের বর্তমান চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. আবদুস ছালাম। অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের আন্তরিকতায় প্রথম প্রাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে শতভাগ পাস সহ চমকপ্রদ ফলাফল লাভ করে শিক্ষাবোর্ড মডেল কলেজ। এর পর থেকে অধ্যক্ষ ছালামের আমলে বারবারই পাবলিক পরীক্ষায় বোর্ডেও টপ টেনে স্থান পায় প্রতিষ্ঠানটি। আবদুস ছালাম বদলী হলে অধ্যক্ষ পদে আসেন প্রফেসর মো.রুহুল আমীন ভূইয়া। আগের অধ্যক্ষের পথ ধরে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সাথে আন্তরিকতাপূর্ণ পরিবেশে কলেজটিকে এগিয়ে নেন। ২০১৬ সালে ড. এমদাদুল হকের যোগদানের পর কোন বিধি বিধানের তোয়াক্কা না করে নিজের ইচ্ছেমতো স্বৈরতান্ত্রিকভাবে কলেজ চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ শিক্ষকদের।

কলেজের শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক লুতফুরন্নাহার লাকী ও গনিত বিভাগের প্রভাষক কাজী মো, ফারুক সহ ভুক্তভোগী শিক্ষকরা জানান, কলেজের অধ্যক্ষসহ ২৫ জন শিক্ষকের মধ্যে আমরা ২০ জন শিক্ষক আজ বিভিন্নভাবে হয়রানীর শিকার হয়ে উর্ধ্বতন কতৃপক্ষের কাছে প্রতিকার চেয়ে আবেদন করেছি। একজন শিক্ষকের জাতীয়করণ প্রক্রিয়া চলমান থাকায় তিনি চাপের মুখে ক্ষুব্দতা প্রকাশ করছেন না। জাতীকরণ হওয়া ১৮ জন প্রভাষকের মধ্যে ১৭ জন প্রভাষক অধ্যক্ষের কর্মকান্ডে ক্ষুব্দ। মাত্র একজন প্রভাষকসহ ৩ জন শিক্ষককে ‘অবৈধ সুবিধা’ দিয়ে হাতে নিয়ে অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন অধ্যক্ষ। হোস্টেল সুপারের নুন্যতম যোগ্যতা ‘প্রভাষক’ হলেও তিনি বিধি বর্হিভূতভাবে উনার অনুগত জীব বিজ্ঞান বিভাগের প্রদর্শক জগলুল হাছান পটোয়ারীকে হোস্টেল সুপারের দায়িত্ব দিয়েছেন। সিনিয়র শিক্ষকদের বাদ দিনে উনার এলাকার লোক বাংলা বিভাগের প্রভাষক ফাহিমা আক্তার কে ‘ ক্রয় কমিটির’ প্রধান করে কলেজের অর্থ লুটপাট করছেন কিনা তা তদন্তের প্রয়োজন। এই দুই শিক্ষক ভূয়া ভর্তি কমিটিরও সদস্য। স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে পরিচিত কলেজের শরীরচর্চা শিক্ষক জি এম ফারুক কে দিয়ে ‘জাতীয় শোক’ সহ বিভিন্ন জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠান ‘উপস্থাপনা’ করিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আঘাত করছেন। বর্তমানে তাকে দিয়ে অধ্যক্ষের কর্মকান্ডে প্রতিবাদ করা শিক্ষার্থীদের দমক হুমকীসহ হয়রানী করাচ্ছেন। জি এম ফারুক অধ্যক্ষর পক্ষ নিয়েছেন নগ্নভাবে। ফেসবুকে এক শিক্ষার্থীর কমেন্টের জবাবে তিনি বলেছেন, “ একজন অধীনে এটা নৈতিক দায়িত্ব । তার বসের বিশ^স্ত ও আস্থাভাজন হওয়া। ”

সমাজকর্ম বিভাগের প্রভাষক রেজোয়ার আক্তার ও আইসিটি বিভাগের প্রভাষক সোহেল কবীর বলেন, “অধ্যক্ষ ড. এমদাদুল হক সংস্কৃতি চর্চার নামে কলেজে অপসংস্কৃতি চালু করেছেন। সামাঞ্জস্য নয় এমন অনুষ্ঠানেও ছাত্রীদের নৃত্যের আয়োজন করেন। স্কুলের শিক্ষার্থীদের র‌্যাগ-ডে নামে ডিজে পাটি আয়োজনে উৎসাহিত করে আসছেন যা অনেক অভিভাবকের আপত্তি রয়েছে। করোনাকালে আমরা চাই না সরকারি নির্দেশনার বাহিরে ঝুঁকি নিয়ে আমতলা কিংবা জামতলায় যাক।”

হিসাববিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক উজ¦ল চক্রবত্রী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মায়মুন শরীফ রায়হান বলেন, আমরা এ অবস্থার অবসান চাই। ছাত্র-শিক্ষকের আগের অবস্থা ফিরে ফেতে চাই। আমাদের অভিযোগ অধ্যক্ষের প্রতি,প্রতিষ্ঠানের প্রতি নয়। আমাদের সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীরা যেন বঞ্চিত না হয় সেদিকে নজর রাখছি। নিয়মিত আমরা অনলাইন ক্লাস নিচ্ছি। শুধুমাত্র সরকারি নির্দেশনার বাহিরে অধ্যক্ষ যে আদেশ দিচেছন তা বর্জন করছি। আমরা চাই আবারও নিয়মতান্ত্রিক সুস্থধারায় কলেজ পরিচালনার মাধ্যেমে হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার সুযোগ দিতে উর্ধ্বতন কতৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছি।”

অভিভাবক জাকির হোসেন,শাহীন মজুমদার, নাসরিন আক্তার, শিউলি দাশ বলেন, কলেজের আগের অধ্যক্ষরা শিক্ষার্থীদের সাথে সম্পর্ক গড়েছেন আন্তরিকতা দিয়ে আর বর্তমান অধ্যক্ষ সম্পর্ক মূল্যায়ন করছেন ফেসবুকের লাইক কমেন্টে দিয়ে। শিক্ষকদের প্রচেষ্টায় কলেজটি অল্প সময়ে কুমিল্লার একটা খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানের পরিনত হয়েছে। অধ্যক্ষের কারণে বর্তমানে কলেজে অচল অবস্থা বিরাজ করছে। যেখানে ২৪ জন শিক্ষকের মধ্যে ২০ জন অধ্যক্ষের বিপক্ষে সেখানে অধ্যক্ষের অপসরন জরুরী।

এদিকে গত ১ ফেব্রুয়ারি নগরীর পূবালী চত্বরে বেলা পৌনে ১১ থেকে ঘণ্টাব্যাপী এ মানবন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। এ সময় বিভিন্ন ব্যানার ও ফেস্টুন নিয়ে সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা ড. এমদাদুল হক অপসারণের দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। মানববন্ধন শেষে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. কামরুল হাসানের কাছে স্মারকলিপি পেশ করেন তারা।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ২০১৬ সালে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে কলেজটিতে স্বেচ্ছাচারিতা ভর্তি-বাণিজ্য, নারী সহকর্মী, ছাত্রীদের সঙ্গে অশোভন আচরণসহ বিভিন্ন অনিয়ম করে আসছেন কলেজ অধ্যক্ষ ড. এমদাদুল হক। তাকে অপসারণ না করা পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।

মডেল কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাইফুল ইসলাম সজীব এর সঞ্চালনায় মানবন্ধনে বক্তব্য রাখেন, প্রাক্তণ শিক্ষার্থী কাজী তাইমুল, মাহমুদ হাসান নীরব, তাহফিমা মাহমুদ প্রমুখ।

প্রাক্তন শিক্ষার্থী ফাহিম আহমদ তাজওয়ার ও সাব্বির আহমেদ বলেন, “ আমাদের দাবি একটাই এমদাদতন্ত্র নিপাক যাক.মডেল কলেজ মুক্তি পাক। চলতি সপ্তাহে অধ্যক্ষের অপসরন না হলে আগামী সপ্তাহে আমরা নতুন কর্মসূচি ঘোষনা করব।”

এদিকে গত ডিসেম্বরে কলেজ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে এক অভিভাবকের ভর্তি বানিজ্যের অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার কাছে পত্র প্রেরণ করেন। বোর্ডের তদন্তে অভিযোগ প্রমানিত হয়। গত জানুয়ারী মাসে তদন্ত রির্পোট শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। একটি সূত্রে জানা গেছে, অচিরেই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে মন্ত্রনালয়।

এসব বিষয়ে কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড সরকারি মডেল কলেজের অধ্যক্ষ ড. এ কে এম এমদাদুল হক বিভিন্ন মিডিয়ায় পাঠানো তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আমার আমলে কলেজটি বারবার শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খ্যাতি অর্জন করেছে। আমিও শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ নির্বাচিত হয়েছি। কিছু শিক্ষক কোচিং বানিজ্য চালাতে না পেরে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করছে। বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবগত রয়েছেন। ষড়যন্ত্র করে শিক্ষাবোর্ড সরকারী মডেল কলেজের অগ্রযাত্রাকে কেউ থামাতে পারবেনা।

     আরো দেখুন:

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০  

You cannot copy content of this page