নিউজ ডেস্ক।।
একসঙ্গে কাজ করতেন তিন বন্ধু। কখনও নির্মাণশ্রমিক, কখনও অটোরিকশা চালক। থাকতেন কুমিল্লায়। শ্বশুরবাড়ির এলাকায় মাহফিলের কথা শুনে যান ঘুরতে। মাহফিল থেকে শ্বশুরবাড়িতে ফলফলাদি নিয়ে যান। সেখানে খাবার খাওয়া অবস্থায় ডাকাত সন্দেহ করে তিন যুবককে গণপিটুনি দেয় স্থানীয় একটি চক্র। ঘটনাস্থলেই নিহত হন দুই যুবক। যাদের কারও ঘরে আছে ২১ দিনের নবজাতক, কারও ঘরে আছে নয় বছরের মাদ্রাসা পড়ুয়া শিশু সন্তান।
উপজেলার কোথাও সেদিন ডাকাতির ঘটনা ঘটেনি। তারপরও এভাবে হত্যার শিকার হন ওই যুবকরা। কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলায়র দারোরা ইউনিয়নের পালাসুতা গ্রামে বৃহস্পতিবার (১২ জানুয়ারি) রাত ১১টার পর এ ঘটনা ঘটে। গণপিটুনিতে অংশ নেয় পালাসুতা ও আশপাশের গ্রামের মানুষ।
এ ঘটনার দুই দিন কাটলেও কোনও মামলা দায়ের করা হয়নি। এদিকে পুলিশ গ্রামের কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে পুরো গ্রাম।
নিহতরা হলেন– কাজিয়াতল গ্রামের আব্দুস ছালামের ছেলে নুরু মিয়া (২৮), পালাসুতা গ্রামের মৃত গিয়াস উদ্দিনের ছেলে ইসমাইল হোসেন (২৭)। আহত হয়েছেন– কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার কোটবাড়ি বাঘমারা গ্রামের সেলিম মিয়ার ছেলে শাহ জাহান (২৮)।
নিহত কাজিয়াতল গ্রামের নুরু মিয়ার ভাই কামরুল হাসান বলেন, ‘আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে কোনোদিন কোনও মামলা হয়নি। আমরা খেটে খাওয়া মানুষ। চুরি-বাটপারির কোনও অভিযোগ আমাদের বিরুদ্ধে নেই। ভাবি থাকে ভাইয়ের সঙ্গে কুমিল্লায়। ভাবিকে ভাই বলে এসেছে সে শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছে। নয় বছরের বাচ্চাটা স্থানীয় একটা মাদ্রাসায় পড়ে। সে শ্বশুরবাড়িতেই (শিশুর নানার বাড়ি) থাকে। যাওয়ার সময় আব্বার সঙ্গে ভাইয়ের দেখা হয়েছে। আব্বা জিজ্ঞেস করেন, ভাই কোথায় যাচ্ছে? ভাই বলেছে, মাহফিলে যাচ্ছে। শ্বশুরবাড়িতে যেতে হবে। বাচ্চার মাদ্রাসার টাকা দিতে হবে।
‘তারা হেঁটেই সবার সামনে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি যায়। পথে ডাকাত পাহারা দেওয়া জনতার সঙ্গেও দেখা হয়। শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে শ্বশুরের ঘরে ভাত খেতে বসে। সেখান থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে প্রথম দফায় মারধর করে স্থানীয়রা। পরে স্থানীয় কয়েকজন এসে বলে, “তাদের রেখে লাভ নেই। শেষ করে দে।” এই কথা বললে অতি উৎসাহী জনতা তাদের ওপর আবারও হামলা করে। এবং ঘটনাস্থলেই দুজনকে মেরে ফেলে।’
নিহত ইসমাইলের মা মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমার তিন নাতি। একটার বয়স এক মাসের মতো। কী খাওয়াবো তাকে? আমার ছেলের বিরুদ্ধে কোনও মামলা নেই। তারা কেউ চুরি করতেও দেখেনি। যদি ডাকাত হতো তাহলে তো কাছে অস্ত্র পেতো। অস্ত্র কই? তারা খেতে বসেছে, সে সময় তুলে এনেছে। আমি সব জানি, কে করছে এই কাজ।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আলাউদ্দিন আলা নামে এক লোকের বাড়ির সামনে বাড়ি করি। তাই সে মাদক বেচতে পারছিল না। যে কারণে তার বাড়ির আশপাশ থেকে আমাদের চলে যেতে হুমকি দেয়। এর আগেও সে আমার আরেক ছেলেকে চোর বানাতে চেষ্টা করছিল। এরপর আমি আমার ঘরের কোনায় লাইট লাগিয়ে দিলে সে ওই লাইট পর্যন্ত খুলে নিয়ে যায়।
‘যখন এলাকাবাসী ছেলেকে মারধর করে তাকে ছেড়ে দিতে চাইছিল তখন ওই লোক গিয়ে সবাইকে বলে, “তাদের ছাড়িচ না। তারারে রাখি লাভ নাই। শেষ করি দে।” এরপরই শুরু হয় আবার মারধর।’
নিহত ইসমাইলের শ্বশুর আবদুল হক বলেন, ‘শত্রুতা করে আমার জামাইকে মেরেছে। মেয়ে বিয়ে দিয়েছি ১০ থেকে ১৫ বছর আগে। কোনোদিন জামাই চোখ বড় করে কথা কয়নি। আপেল কমলা নিয়া ডাকাতি করতে যায় মানুষ? তাদের কাছে কোনো অস্ত্র পায়নি। কিচ্ছু না। আমরা এই হত্যার বিচার চাই।’
গণপিটুনিতে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি শাহজাহানের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমার সমন্ধির বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ করে আসার পর আমার সঙ্গে কাজ করা নূরে আলম বলেন, “গ্রামে একটা কাজ আছে, চলো ঘুরে আসি। আর বাবাকে দেখে আসি।” সঙ্গে ইসমাইলও ছিল। আমি সরল মনে গেছি। আমরা মাহফিল থেকে যখন তার শ্বশুরবাড়িতে গেলাম, মানুষ আমাদের ঘিরে ধরে মারধর করে। এলাকার মানুষ বলছিল তারা (নিহত দুজন) নাকি ডাকাত।’
নিহত ইসমাইলের বড় ভাইয়ের স্ত্রী আসমা সুলতানা বলেন, ‘এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। কারণ আলাদের (আলাউদ্দিন আলা) বাড়ির সামনে আমাদের বাড়ি। মাদক ব্যবসা করতে পারে না বলে তাদের বাড়ির সামনে থেকে আমাদের চলে যেতে বলে। মেরে ফেলবে বলেও হুমকি দেয়। সে আমাদের তিন শতক জায়গা এর আগেই দখল করে নিয়েছিল। বছর খানেক আগে মামলা করলে আমাদের পক্ষে রায় আসে। এরপর থেকে সে আরও ক্ষুব্ধ ছিল।’
সেদিন রাতে ইসমাইল বাড়ি আসবে এই খবর আলা কীভাবে জানলো এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সে অনেকদিন ধরেই পরিকল্পনা করে রেখেছিল। তখন ডাকাতি নিয়ে এলাকায় একটা গুজব ছড়াছড়ি চলছিল। যতটুকু ধারণা, এর মাঝেই আলা নুরু মিয়াকে দিয়ে আমার দেবরকে এলাকায় এনেছে। তাই সে আগে থেকেই জানতো।’
মুরাদনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুজ্জামান তালুকদার বলেন, ‘নিহত দুই জনের বিরুদ্ধে কোনও মামলা আছে বলে আমরা এখনও জানতে পারিনি। তবে আহত শাহ জাহানের বিরুদ্ধে একটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলা আছে। ঘটনার পর থেকে পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনও মামলা হয়নি। লাশ ময়নাতদন্ত শেষে দাফন করা হয়েছে। আমরা খোঁজ নিচ্ছি। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও বিষয়টি বিশেষ নজরে রেখেছেন।’
আরো দেখুন:You cannot copy content of this page