একই সাথে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ শিক্ষার্থী বহিষ্কার; শাস্তি পুনর্বিবেচনার দাবি

বি এম ফয়সাল, কুবি।।
সম্প্রতি র‍্যাগিংয়ের অভিযোগে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) মার্কেটিং ও নৃবিজ্ঞান বিভাগের মোট ১২ শিক্ষার্থীকে ছয় মাসের জন্য বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলছেন, বহিষ্কার হওয়া সকল শিক্ষার্থী সমান অপরাধী না হয়েও একই শাস্তি পেয়েছেন। তাদের মতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন উচিত শাস্তি পুনঃ বিবেচনা করা যাতে কারো সাথে অন্যায় না হয়।

গত ২ জুলাই মার্কেটিং বিভাগে এবং ৬ জুলাই নৃবিজ্ঞান বিভাগে ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের দ্বারা নিজ নিজ বিভাগের ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা র‍্যাগিংয়ের শিকার হন। অভিযোগ উঠে নবীনদের থাপ্পড় দেওয়া, বেঞ্চের উপর দাঁড় করানো, “বাপ লাগি” বলে গালাগালি দেওয়া, সিগারেট খেতে জোর করা এবং ডায়ালাইসিস করানো শিক্ষার্থীর ক্যানুলা খুলে ফেলা হয়।

ঐ ঘটনা অভিযোগের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটি অভিযুক্ত শিক্ষার্থী, ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী, ব্যাচের সিয়ার (ক্লাস রিপ্রেজেনটেটিভ), প্রত্যক্ষদর্শিদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট শৃঙ্খলা কমিটির নিকট তুলে ধরেন। এর প্রেক্ষিতে শৃঙ্খলা কমিটি দুই বিভাগের মোট ১২ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করেন। মার্কেটিং বিভাগের ৭ জন শিক্ষার্থী হলেন শয়ন চন্দ্র দাস, তাসনিম কাদের ইরফান, শাখাওয়াত হোসেন, ওয়াহিদুল ইসলাম, মতিউর রহমান, ইসরাত জাকিয়া নিহা, ও আকিব জামান। নৃবিজ্ঞান বিভাগের ৫ জন বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীরা হলেন, তিশা মনি, অলিউল্লাহ, অরবিন্দু চন্দ্র সরকার, রাফিও হাসান ও সাদিয়া সরকার।

তবে ব্যাচগুলোর শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, নির্দিষ্ট ২-৩ জন শিক্ষার্থী র‍্যাগের সাথে সরাসরি জড়িত। অন্যরা তেমন ভাবে জড়িত নেই। এদিকে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের দাবি, অভিযোগে যেসব ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে, তা পুরোপুরি সত্য নয় ।

নবীন শিক্ষার্থীকে থাপ্পর দেওয়ায় অভিযুক্ত শয়ন চন্দ্র দাস বলেন, “আমি শুধু তার কাঁধে হাত রেখে নাম ও পরিচয় জানতে চেয়েছিলাম। এ ঘটনাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে আমাদেরই কয়েকজন।” তবে ভুক্তভোগীর মতে তাকে থাপ্পড় মারা হয়।

ডায়ালাইসিস শিক্ষার্থীকে র‍্যাগিংয়ের অভিযোগ প্রসঙ্গে ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, “আমি সেদিন জুনিয়রদের রুম থেকে বের হচ্ছিলাম বাড়ি যাওয়ার জন্য। ঠিক তখন একজন রুমে প্রবেশ করছিল, যার শার্টের হাতা গুটানো ছিল। আমি তাকে হাতা ঠিক করে রুমে ডুকতে বলি। ”

হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ম্যাসেজ দিয়ে জুনিয়রদের রুমে ক্লাসের সবাইকে ডাকার বিষয়ে তাসনিম কাদের ইরফান বলেন, “নবীনবরণের দিন আমাদের ব্যাচের কয়েকজন শিক্ষার্থী ১৯তম ব্যাচের রুমে গিয়েছিল। যেহেতু সেদিন শিক্ষক ও বিভিন্ন ব্যাচের সিআররা উপস্থিত ছিলেন, তাই আমাদের ব্যাচের সবাই প্রোগ্রামে অংশ নিতে পারেনি। রাতের বেলায় বিষয়টি নিয়ে কিছু মতবিরোধ তৈরি হয়। সিআর হিসেবে নিজের দায়ভার এড়াতে আমি প্রস্তাব দিই পরের দিন জুনিয়রদের ক্লাসে যাওয়ার আগে গ্রুপে একটি দিব। পরে সবার সম্মতিতে আমরা সিদ্ধান্ত নিই ক্লাসে গিয়ে কথা বলার, এবং সেই অনুযায়ী গ্রুপে ম্যাসেজ দেই।”

অভিযুক্ত আকিব জামান বলেন, “ঘটনার দিন আমি প্রায় ১০ মিনিট দেরিতে সংশ্লিষ্ট রুমে যাই এবং বিষয়টির প্রমাণ প্রশাসনের কাছে উপস্থাপন করেছি। সেই ক্লাসে আগে-পরে মিলিয়ে আমরা মোট ৪৩ জনই উপস্থিত ছিলাম। অথচ আমাদের মধ্যে থেকে আলাদা করে ৭ জনকে বহিষ্কার এবং আরও ১৭ জনের নাম মুচলেকা নিয়েছে। এটি আমাদের ব্যাচেরই কারও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পরিকল্পনা।”

অভিযুক্ত আরেক শিক্ষার্থী শাখাওয়াত হোসেন বলেন, “ঘটনার সময় সবাই যখন রুম থেকে বের হচ্ছিল, তখন আমি তাদেরকে সিনিয়রদের সালাম দেওয়া এবং বিভাগীয় শৃঙ্খলা ও আচরণবিধি সংক্রান্ত কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছিলাম। অথচ সেটিই এখন আমার অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।”

১৮ তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ঐদিন শয়ন দাস ও ওয়াহিদুল ইসলাম অন্যদের তুলনায় অতিরিক্ত করে ফেলেছিলেন। এছাড়াও ইরফান ১৯ তম ব্যাচে যাওয়ার জন্য ঘোষণা দিয়েছিলেন।

নৃবিজ্ঞান বিভাগের ১৮ তম ব্যাচের অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের বিষয়ে জানা যায়, ২ জুলাই রাফিও হাসান এবং অলি উল্লাহ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে একটি চায়ের দোকানে নিয়ে র‍্যাগ দেয় এবং গালাগাল করে। । ৩ জুলাই রাত ১০ টার পর সালমানপুর গ্রামের ভিতরে অবস্থিত তালতলায় নিয়ে যায় এক শিক্ষার্থীকে সিগারেট খেতে জোর করেন। এছাড়া অলি উল্লাহ জুনিয়র শিক্ষার্থীদেরকে গালাগাল করেন। ৪ জুলাই ভুক্তভোগী এক শিক্ষার্থীকে সাংবাদিকদের সাথে দেখে রাফিও রাগান্বিত হয়ে অলি উল্লাহকে জানায়। পরবর্তীতে অলি উল্লাহ এবং রাফিও ঐ শিক্ষার্থীকে ১৯ ব্যাচের সি আর এর মাধ্যমে নজরুল হলের ১০৯ নং রুমে নিয়ে গিয়ে র‍্যাগ দেয় এবং গালাগাল করেন।

এদিকে তিশা মনি হৃদের বিরুদ্ধে দেখা হওয়ার পর সালাম না দেওয়ায় একজনকে জুনিয়র শিক্ষার্থীকে বেঞ্চে দাঁড় করানো এবং তার পারিবারিক শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলে গালাগাল করেন।

অন্যদিকে সাদিয়া সরকার ও অরবিন্দু সরকার ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন। ২ জুলাইয়ে চায়ের দোকানে রাফিও, অলি উল্লাহ তাদের সাথে উপস্থিত ছিলেন সাদিয়া সরকার এবং ৩ জুলাই সালমানপুরে অবস্থিত তালতলায় র‍্যাগিংয়ের সময় রাফিও হাসান এবং অলি উল্লাহর সাথে উপস্থিত ছিলেন অরবিন্দু সরকার। তবে এই দুইজন ভুক্তভোগীদের র‍্যাগ দেননি এবং তাদের বিরুদ্ধে র‍্যাগিংয়ের সুস্পষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায়নি।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অভিযুক্ত ১২ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দেয়।

শিক্ষার্থীদের ভাষ্যমতে, উপস্থিত সকল শিক্ষার্থী সমানভাবে অপরাধ করে নি। তাদের কেউ কম বা কেউ বেশি অপরাধ করেছে। ফলে সবাইকে একই শাস্তি দেওয়া ঠিক নয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে গিয়ে অন্যায় যেন না করেন এমনটাই তাদের প্রত্যাশা।

এ বিষয়ে আইন বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আরিফ বলেন, ‘আমি বলতেছি না যে কেউ শাস্তি পাবে না। র‍্যাগ দিলে অবশ্যই শাস্তি পাবে। কিন্তু ১২ জনকে এক সঙ্গে বহিষ্কার করা মানে সবাইকেই সমান দোষী বানানো হয়েছে। অথচ ঘটনা তো সবাই একভাবে জড়িত ছিল না। কেউ হয়তো ভুল করেছে, কেউ হয়তো পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেছে। বিচার তো হওয়া উচিত কে কতটুকু দোষ করেছে, সেই অনুযায়ী। এমন শাস্তি দিলে তো যারা তুলনামূলক কম দোষ করেছে, তাদের উপর অন্যায় হইতেছে।’

মার্কেটিং বিভাগে র‍্যাগিংয়োর ঘটনায় তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ড. মোহাম্মদ আহসান উল্লাহ বলেন, আমরা তদন্ত কমিটি ফ্যাক্টগুলো যাচাই বাছাই করে শৃঙ্খলা কমিটির কাছে রিপোর্ট দিয়েছি।

কার কেমন অপরাধ তা আপনারা স্পেসিফিক করে দিয়েছিলেন কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সেটা আপনি শৃঙ্খলা কমিটির কাছ থেকে জানে নিন। আমার জায়গা থেকে আমি এ তথ্য দিতে পারি না।

এ বিষয়ে জানতে প্রক্টর আব্দুল হাকিমকে একাদিকবার কল দিলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে র‍্যাগিংয়ে জড়িত শিক্ষার্থীদেরকে শাস্তি প্রদানের ব্যাপারে ১৮তম আবর্তনের শিক্ষার্থীদেরকে অবগত করা হয়েছিলো এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হবে বলে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিলো।

     আরো দেখুন:

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১
১২১৩১৪১৫১৬১৭১৮
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭২৮২৯৩০৩১  

You cannot copy content of this page