নিউজ ডেস্ক।।
রাঙামাটিতে শিক্ষক মা-বাবা থেকে অনেক দূরে ঢাকায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের হোস্টেলে থাকত উক্য চিং মারমা। ক্লাস সেভেনের এই ছাত্র এ বছরই এখানে ভর্তি হয়। এর আগে পড়ত মিরপুরের এক স্কুলে। হোস্টেলে মা-বাবাকে ছাড়া থাকতে কোন শিশুরইবা ভালো লাগে। তাই ফাঁক পেলেই তাঁদের ফোন করে জানতে চাইত, কখন তাঁরা ঢাকায় আসবেন, এটা-সেটা কিনে দেবেন।
শেষ যখন কথা হয়েছিল, উক্যর বাবা তাকে বলেছিলেন, আগস্টের ১৫ তারিখে ঢাকায় আসবেন তিনি। বাবাকে দেখার জন্য প্রহর গুনছিল ১২ বছরের এই শিশু। গতকাল সোমবার সব থেমে গেল।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে গতকাল যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে যে ৩১ জন নিহত হয়েছে, সেই তালিকায় রয়েছে উক্যর নামও।
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ঢাকায় এসে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ছুটে যান উক্যর বাবা উসাইমং মারমা। নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রের (আইসিইউ) বাইরে অপেক্ষা করতে করতে রাত ২টার দিকে তাঁকে জানানো হয়, ছেলে আর নেই।
উসাইমংয়ের আর কোনো সন্তান নেই। উক্যই তাঁর একমাত্র সন্তান। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা তিনি।
আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে হাসপাতাল থেকে ছেলের মরদেহ বুঝে পেয়ে গ্রামের বাড়ি রওনা হন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনার কথা শুনে তড়িঘড়ি করে আসলাম। কিন্তু ওর সাথে শেষবারের মতো আর কথা হলো না। দিনে ছয় থেকে সাতবার কথা হতো ওর সাথে। শেষবার বলছিল, “বাবা, তুমি কবে আসবা?” আমি তাকে বলেছিলাম, এখন তো সময় পাচ্ছি না। ঢাকায় যেতে টাকা-পয়সার ব্যাপার-স্যাপার আছে। আগামী মাসের ১৫ তারিখ আমি অবশ্যই আসব। তোমার যা যা কেনা দরকার, আমি কিনে দেব। সেই দেখা আর হলো না।’
উসাইমং রাঙামাটির রাজস্থলী উপজেলার বাঙ্গালহালিয়া কলেজপাড়া এলাকার বাসিন্দা। রাজস্থলী উপজেলার আবাসিক উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক তিনি।
উসাইমং ও তাঁর স্ত্রীর স্বপ্ন ছিল, রাঙামাটিতে না পড়িয়ে ঢাকায় নামী কোনো স্কুলে ছেলেকে পড়াবেন, যাতে তার পড়াশোনায় কোনো ঘাটতি না থাকে।
এ জন্য রাঙামাটি ছেড়ে বান্দরবানে পাড়ি জমান উসাইমং ও তাঁর স্ত্রী। নার্সারি থেকে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত বান্দরবানের একটি স্কুলে পড়ে উক্য। এরপর ক্লাস সিক্সে ঢাকায় মিরপুরের আদর্শ নিকেতনে ভর্তি করানো হয় তাকে। মাইলস্টোন স্কুলের সুনাম থাকায় এ বছর ক্লাস সেভেনে দিয়াবাড়ি ক্যাম্পাসে তাকে নিয়ে আসা হয়।
উসাইমং বলেন, ‘ছেলের পড়ালেখার জন্য আমরা রাঙামাটি ছেড়ে বান্দরবানে গিয়েছিলাম। এরপর ভালো স্কুলে পড়াতে ঢাকা পাঠালাম। কে জানত, ওর লাশ নিয়ে ঘরে ফিরতে হবে।’
তিনি জানান, হোস্টেলে মোবাইল ফোন ব্যবহারে বিধিনিষেধ রয়েছে। তারপরও মোবাইল ফোন হাতে পেলেই তাঁকে মিসড কল দিত উক্য। বিমান দুর্ঘটনার আগের দিনও বেশ কয়েকবার মিসড কল দিয়েছিল সে। কথাও হয়েছিল কয়েকবার। দুর্ঘটনার দিন সকালে বাবা-ছেলে দুজনেরই স্কুলে যাওয়ার তাড়া থাকায় আর কথা হয়নি তাদের।
একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ উক্যর মা। স্বামীর সঙ্গে তিনিও ঢাকায় এসেছেন। পেশায় স্কুলশিক্ষক। তাঁর কাছে ট্রলি ব্যাগের আবদার করেছিল উক্য।
উসাইমং বলেন, ‘এবার ঢাকায় গিয়ে উক্যকে ট্রলি ব্যাগ কিনে দেব ভেবেছিলাম। তার আগেই চলে গেল।’
রাজস্থলী উপজেলার বাঙ্গালহালিয়ার গ্রামে উক্যর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হবে বলে জানান তিনি। সরকারের কাছ থেকে কোনো ক্ষতিপূরণ চান না বলেও জানান।
উসাইমং বলেন, ‘সরকার হয়তো বলতে পারে, আপনাদের ক্ষতিপূরণ দেব। কিন্তু ক্ষতিপূরণ দিয়ে কী হবে? ছেলে তো আর ফিরবে না।’
আরো দেখুন:You cannot copy content of this page