যে তিন কারণে এসএসসির ফল খারাপ

নিউজ ডেস্ক।।
দেশের নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন এ বছরের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে খারাপ হয়েছে। গড় পাসের হার ও ফলাফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ-৫ সবই কমেছে। সব পরীক্ষার্থী ফেল করেছে—এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে। কমেছে শতভাগ পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও।

ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এবার মূলত তিনটি কারণে ফল খারাপ হয়েছে। প্রথমত, এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থীরা গত পাঁচ বছরের শিক্ষাজীবনে করোনা মহামারিসহ নানা কারণে বিদ্যালয়ে ক্লাস পেয়েছে কম। দ্বিতীয়ত, ‘প্রশ্ন কঠিন’ হওয়ায় এবার গণিতে পাসের হার কম। তৃতীয়ত, এবার উত্তরপত্র মূল্যায়নে অন্যান্য বছরের চেয়ে ‘কড়াকড়ি’ ছিল।

গতকাল বৃহস্পতিবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এবার নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন এসএসসি পরীক্ষা দেয় ১৪ লাখ ৭৯ হাজার ৩১০ জন পরীক্ষার্থী। পাস করেছে ১০ লাখ ৬ হাজার ৫৫৪ জন। পাসের হার ৬৮ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ; যা গতবার ছিল ৮৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এবার গতবারের চেয়ে জিপিএ-৫ কমেছে ৩৮ হাজার ৮২৭।

মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীন দাখিল এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনাল পরীক্ষার ফলও গতকাল প্রকাশিত হয়েছে। এবার ফলাফল প্রকাশ উপলক্ষে আনুষ্ঠানিকতা রাখা হয়নি। শিক্ষা বোর্ডগুলো আলাদাভাবে ফলাফল প্রকাশ করেছে। তবে আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির পক্ষে কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দোকার এহসানুল কবির সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করে ফলাফলের বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন।

২০২০ সাল থেকে গতকাল পর্যন্ত প্রকাশিত ফলাফলগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এবার ফল সবচেয়ে খারাপ হয়েছে। ২০২০ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত সব বছরেই পাসের হার ৮০ শতাংশের বেশি ছিল।

পাসের হারে এবার সবচেয়ে পিছিয়ে পড়েছে বরিশাল শিক্ষা বোর্ড। এই বোর্ডে পাসের হার ৫৬ দশমিক ৩৮। আর পাসের হারে এগিয়ে আছে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড। এই বোর্ডে পাসের হার ৭৭ দশমিক ৬৩। এ ছাড়া ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৬৭ দশমিক ৫১ শতাংশ, কুমিল্লা বোর্ডে ৬৩ দশমিক ৬০ শতাংশ, যশোরে ৭৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ, চট্টগ্রাম বোর্ডে ৭২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, দিনাজপুর বোর্ডে ৬৭ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ এবং ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৫৮ দশমিক ২২ শতাংশ।

শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে ক্লাস পেয়েছে কম
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এবার যারা এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়, তারা ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক স্তরের মোট পাঁচ বছরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সময় বিদ্যালয়ে ক্লাস পায়নি। এর মধ্যে এ বছরের এসএসসির নিয়মিত পরীক্ষার্থীরা ২০২০ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে ওই বছরের ১৭ মার্চ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি শুরু হয়েছিল। তখন টানা দেড় বছর ছুটি ছিল। দ্বিতীয় দফায় করোনার কারণে ২০২২ সালের ২১ জানুয়ারি আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করে সরকার। সেবারও এক মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে।

করোনার বন্ধের পাশাপাশি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণেও অনেক দিন ক্লাস হয়নি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। ফলে শিখন–ঘাটতি নিয়েই ওপরের শ্রেণিতে উঠেছে এবং পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থীরা।

পাসের হার এবং জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেয়েরা এগিয়ে। মেয়েদের পাসের হার প্রায় ৭১ শতাংশ। আর ছেলেদের পাসের হার ৬৫ শতাংশের বেশি। জিপিএ–৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৬ হাজার ৭৮০ জন ছাত্রী ও ৫৮ হাজার ২৩৮ জন ছাত্র।

গণিতে পাসের হার কম
এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থীরা পূর্ণ পাঠ্যসূচিতে পরীক্ষা দিয়েছে। এর মধ্যে পরীক্ষায় গণিতসহ কয়েকটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ‘কঠিন’ করা হয়। এবার গণিতে পাসের হারও কম। যেমন ঢাকা বোর্ডে এবার গণিত বিষয়ে পাসের হার ৭৫ দশমিক ১৪ শতাংশ; যা ইংরেজিতে প্রায় ৮৮ শতাংশ, বাংলায় প্রায় ৯৭ শতাংশ, পদার্থে প্রায় ৯৩ শতাংশ, রসায়নে প্রায় ৯৫ শতাংশ, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ে ৯৮ শতাংশ, পৌরনীতিতে ৯৪ শতাংশ এবং হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে পাসের হার ৯২ শতাংশের বেশি। অন্যান্য শিক্ষা বোর্ডেও গণিতে পাসের হার কম।

গণিত বিষয়টি সবার জন্যই বাধ্যতামূলক। এ বিষয়ের খারাপ ফল সার্বিক ফলের ওপর প্রভাব ফেলেছে।

উত্তরপত্র মূল্যায়নে ‘কড়াকড়ি’
এ ছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোর চেয়ে এবার উত্তরপত্র মূল্যায়নে ‘কড়াকড়ি’ ছিল। অন্যান্য বছর কিছুটা নমনীয়তা দেখানো হলেও এবার সেটা করা হয়নি।

উত্তরপত্র মূল্যায়নে ‘কড়াকড়ির’ বিষয়ে শিক্ষা বোর্ডগুলোর চেয়ারম্যানদের সংগঠন আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দোকার এহসানুল কবির গতকাল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমাদের কোনো টার্গেট ছিল না যে পাসের হার এত করব, বাড়াব, নাকি কমাব। আমাদের মিশন ছিল পরীক্ষা সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা।’ তিনি বলেন, ‘উত্তরপত্র মূল্যায়নে শিক্ষকেরা যখন উত্তরপত্র নিতে এখানে (বোর্ডে) আসেন, তখন ওনাদেরও প্রশ্ন ছিল কোনো নির্দেশনা আছে কি না। আমরা বলেছি, আমাদের বিশেষ কোনো নির্দেশনা নেই।…মূল্যায়ন যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়ে আমাদের কাছে এই ফলাফল এসেছে।’

জিপিএ-৫–এ বড় ধাক্কা
ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২১ সালের পর থেকে এ বছর পর্যন্ত এবারই সবচেয়ে কম জিপিএ-৫ পেয়েছে শিক্ষার্থীরা। ২০২১ সালে জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৪০ জন, ২০২২ সালে ছিল ২ লাখ ৩৫ হাজার ৪৯০ জন, ২০২৩ সালে ছিল ১ লাখ ৫৯ হাজার ২২০ জন এবং গত বছর ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৪৫। এবার তা কমে হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ১৮ জন।

পাসের হার এবং জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেয়েরা এগিয়ে। মেয়েদের পাসের হার প্রায় ৭১ শতাংশ। আর ছেলেদের পাসের হার ৬৫ শতাংশের বেশি। জিপিএ–৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৬ হাজার ৭৮০ জন ছাত্রী ও ৫৮ হাজার ২৩৮ জন ছাত্র।

শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠান কমেছে
এবার সারা দেশে ৩০ হাজার ৮৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। ৯৮৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব পরীক্ষার্থী পাস করেছে। গতবার শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠান ছিল ২ হাজার ৯৬৮টি।

এবারের ১৩৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজন পরীক্ষার্থীও পাস করতে পারেনি। গতবারের চেয়ে এবার এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে ৮৩।

এবারের সার্বিক ফলাফল বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান বলেন, যথাযথ দক্ষতা অর্জন করে সব শিক্ষার্থী পাস করবে, এটি হলো প্রত্যাশা। পাস-ফেলকে বড় ইস্যু না করে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাক্রম অনুযায়ী প্রতিটি শ্রেণিতে যথাযথ দক্ষতা অর্জন করতে পারছে কি না, সেটিতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

     আরো দেখুন:

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১
১২১৩১৪১৫১৬১৭১৮
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭২৮২৯৩০৩১  

You cannot copy content of this page