নিউজ ডেস্ক।।
১১ দিন আগে কাতার থেকে দেশে ফেরেন সুমন (২১)। সোমবার (৭ মার্চ) বিয়ের জন্য পাত্রীও দেখেছেন। মঙ্গলবার মা তাজু বেগম শবেবরাতের রোজা রাখেন। সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে মায়ের জন্য ইফতারি আনতে বাসার পাশের সিদ্দিক বাজারে যান। আচমকা বিস্ফোরণে সড়কে ছিটকে পড়েন। রক্তাক্ত সুমনকে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
শেষ বিকালে রাজধানীর সিদ্দিক বাজারের নর্থসাউথ রোডের সাততলা পৌর ভবনে বিস্ফোরণে নিহত ১৮ জনের একজন কুমিল্লার সুমন। কুমিল্লায় পৈতৃক বাড়ি হলেও দীর্ঘদিন ধরে সুমনরা থাকেন সিদ্দিক বাজারের সুরিটোলা এলাকায়। তার মূল বাড়ি কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার চালিয়াভাংগা ইউনিয়নে। বাবার নাম মোহাম্মদ মমিন।
সুমনের বাবা বলেন, ‘সুমনের জন্মের আগে আমার অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। একবেলা খেলে আরেক বেলা না খেয়ে কাটতো। ২৫ বছর আগে মেঘনার তীরের ঘরটি ভেসে যায় নদীর পেটে। টানাপোড়নের সংসারে নেমে আসে দুর্বিষহ দিন। শূন্য হাতে আসি ঢাকায়। অনিশ্চিত জীবনের সঙ্গী হয় সুমনের মাসহ পুরো সংসার। নানান জায়গায় ভবঘুরে হয়ে কাজ করার কয়েক বছর পর স্থায়ী হই ঢাকার সিদ্দিক বাজারের সুরিটোলা এলাকায়। পরে সুমনের জন্ম।’
কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘পেট চালাতে গিয়ে ছেলেকে আর পড়াশোনা করাতে পারেননি। শিশু বয়সেই যুক্ত হয় আমার সঙ্গে। তিন বছর আগে ভাগ্য বদলাতে সুমন পাড়ি দেয় কাতারে। তার তিন ভাই বোন আর আমি আর আমার স্ত্রী- পুরো পরিবারের দায়িত্ব সুমনের কাঁধে। এর মাঝে এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে। সংসারের অভাব কেটে সুখের আলোর দেখা মিলতে থাকে। কিন্তু ভাগ্য খুব বেশি সহায় হয়নি।’
মোবাইলে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন। একপর্যায়ে বলেন, ‘২৫ ফেব্রুয়ারি প্রবাস থেকে এসেছে সুমন। বিয়ে করবে তাই গতকাল গেন্ডারিয়া এলাকায় মেয়েও দেখতে যাই। পছন্দও হয়েছে। বুধবার সব ঠিক হওয়ার কথা।’
ছেলে হারানোর শোকে কাতর এই বাবা আরও বলেন, ‘দুপুরে আমার সঙ্গে খাবার খেয়েছে সুমন। খাবার খেয়ে বলে, আব্বা তুমি মার কাছ থেকে খরচ নিয়া দোকানে যাও। আমি মায়ের ইফতারি আনতে যাই। একসঙ্গে বাবা ছেলে বের হলাম। সে গেলো সিদ্দিক বাজার। আমি দোকানে। একটু পরেই খবর পাই, বিস্ফোরণ হয়েছে। একসঙ্গে ঘর থেকে বের হওয়া ছেলেটাকে দেখি, ঢাকা মেডিক্যালের ফ্লোরে পড়ে আছে। ডাক্তার বলে, আমার ছেলে নাকি মারা গেছে। ইফতারি না এনেই মারা গেছে।’
এদিকে, সুমনের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার চালিয়াভাংগা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির বলেন, ‘ঘটনার ২০ মিনিট পরই আমার কয়েকজন বন্ধু সুমনের মৃত্যুর বিষয়ে জানিয়েছে। তখন থেকে অস্থিরতায় আছি। তাদের সারাজীবনই গেলো কষ্টে।’
তিনি বলেন, ‘সুমন সম্পর্কে আমার ভাতিজা ঘরের নাতি। তার জন্মের আগেই বাবা-মা পুরো পরিবারসহ ঘর বাড়ি হারিয়ে ঢাকায় চলে গেছে। তবে সুমনের বাবা মমিন পাশের টিডিরচর এলাকায় বিয়ে করেছেন। তাই বছরে কয়েকবার তারা গ্রামে আসতো। ঢাকার ফুটপাতে জুতা বিক্রি করতো। মমিনের বয়স ৩৮ হবে। তার ঘরে আরেকটা ছেলের জন্ম হয়েছে দেড় বছর আগে। এক মেয়ে খুব কষ্টে বিয়ে দিয়েছে। আরেক মেয়ে এখনও বিয়ের বাকি। ছেলেটার মৃত্যুর পরে কল দিয়েছি। মমিন পাগলের মতো ঢুকরে কাঁদছিল। স্থানীয় কয়েকজনকে বলেছি, গিয়ে তাকে সহায়তা করতে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন, এই গরিব ছেলের পরিবারের দিকে যেন তাকান। তাদের কিছুই নেই। ঘর নিয়ে গেলো নদী আর বিস্ফোরণে গেলো ছেলেটার জীবন।’
উল্লেখ্য, মঙ্গলবার বিকাল পৌনে ৫টার দিকে রাজধানীর পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজার এলাকায় সাত তলা একটি ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে আশপাশের কয়েকটি ভবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৬টি লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে আনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক।
তিনি জানান, নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অন্তত ১২০ জনকে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
সূত্র- বাংলা ট্রিবিউন
আরো দেখুন:You cannot copy content of this page