আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে কুমিল্লায় কর্মস্থলে এখনো অনুপস্থিত তারা

স্টাফ রিপোর্টার।।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আড়াই মাস পেরিয়ে গেলেও কর্মস্থলে আসছেন না সরকারি রাজস্বভুক্ত অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী। কুমিল্লার কোনও সংস্থা বা দফতর এমন তালিকা না করলেও অনুসন্ধানে অন্তত ৭ জনের সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেছে। যাদের অনেকে প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আবার অনেকে রাজনৈতিক দলের নেতার ঘনিষ্ঠ ছিলেন।

তারা হলেন, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ উপাধ্যক্ষ মৃণাল কান্তি গোস্বামী, একই কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ, লাকসাম উপজেলার মুদাফরগঞ্জ আলী নওয়াব উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল মান্নান মজুমদার, কুমিল্লা কারাগারের উপ-তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ মাহাবুবুল ইসলাম, সওজ কুমিল্লা সার্কেল অফিসের কম্পিউটার অপারেটর আনিসুর রহমান ভূঁইয়া, কুমিল্লা জেনারেল (সদর) হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার নজরুল ও সোনালী ব্যাংক কর্মচারী হাসান মাহামুদ চৌধুরী সুমন।

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে গিয়ে দেখা গেছে, কলেজের ডিগ্রি শাখার উপাধ্যক্ষ মৃণাল কান্তি গোস্বামীর কক্ষে ঝুলছে তালা। ৫ আগস্টের পর হাতে গোনা কয়েক দিন আসেন কলেজে তিনি। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আবু জাফর খানের সঙ্গে সাদা কাগজে তিনিও ‘পদত্যাগ করেছেন’ মর্মে সই করেন। এরপর থেকে আর তাকে কলেজে দেখা যায়নি।

এদিকে একই অবস্থা কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে পদায়ন পাওয়া অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফের। ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ। অভিযোগ আছে, আন্দোলন চলাকালে তিনি সাধারণ শিক্ষার্থীদের হামলা করা ছাত্রলীগ নেতাদের হলে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, আমি এতদিন কলেজে যেতে পারিনি। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। তারা এখনও ছোট তো, আবেগে ভুল করেছে। এই পরিস্থিতি ঠিক হয়ে যাবে। তবে গতকাল ইন্টার শাখায় গিয়ে ক্লাস নিয়েছি। তা ছাড়া এর আগেই আমি জয়েন করেছি।

একাধিক শিক্ষক সূত্রে জানা গেছে, সরকার পতনের পর থেকে কর্মস্থলে নেই লাকসাম উপজেলার মুদাফরগঞ্জ আলী নওয়াব উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল মান্নান মজুমদার। তিনি সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রী তাজুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে দীর্ঘদিন এই কলেজে কর্মরত বলে অভিযোগ রয়েছে। একই কলেজে থাকায় তাজুল ইসলামের নেতাকর্মীদের সঙ্গেও তার সখ্য ছিল।

অভিযোগ আছে, অধ্যক্ষ আব্দুল মান্নান মজুমদার রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে প্রতিষ্ঠানে দলীয় লোকজন নিয়োগ করতেন। কলেজের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গেও খারাপ আচরণ করতেন তিনি। শিক্ষকদের বিভিন্নভাবে হয়রানি ও রাজনৈতিকভাবে হেনস্তার হুমকিও দিতেন। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন সময় অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ে কলেজের কাজ করাতেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের দিয়ে। এভাবে তিনি তাদের আরও পছন্দের মানুষ হয়ে যান।

এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে মুদাফরগঞ্জ আলী নওয়াব উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল মান্নান মজুমদার বলেন, যারা আন্দোলন করেছে তারা আমাদের শিক্ষার্থী নয়। সেখানে কয়েকজন আমাদের শিক্ষার্থী। আমি হার্টের রোগী, তাই ছুটি নিয়েছি।

এদিকে কুমিল্লা কারাগারের উপ-তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ মাহাবুবুল ইসলামও ৫ আগস্টের পর থেকে কুমিল্লা জেলখানায় আসছেন না। ‘অসুস্থতার কথা বলে’ কারাগার ছাড়লেও তার দেখা মেলেনি এরপর থেকে। অফিস থেকে কল করেও তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।

আরেকটি সূত্রে জানা গেছে, এই কর্মকর্তা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মা বলে সম্বোধন করতেন। রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে লুটে নিয়েছেন বিপুল পরিমাণ টাকা। নারায়ণগঞ্জ এলাকায় গড়ে তুলেছেন কোটি টাকার শিল্প প্রতিষ্ঠান। ২০২৪ সালের ১২ মে কুমিল্লায় যোগ দেন। তখন কুমিল্লায়ও শুরু হয় তার আরেক সিন্ডিকেট। কিন্তু ৫ আগস্টের পর থেকে পলাতক তিনি।

এ বিষয়ে জানতে উপ-তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ মাহাবুবুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তার মোবাইল নম্বর বন্ধ থাকায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. আব্দুল জলিল বলেন, কারা কর্মকর্তা মাহাবুবুল ইসলাম অনুপস্থিত আছেন, এই তথ্য সত্য। উনি অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে কারাগার ছাড়েন। এরপর থেকে আর আসেননি। আমরা কলও দিয়েছি, কিন্তু ফোন বন্ধ। আমরা তার অনুপস্থিতির তথ্য অধিদফতরকে জানিয়েছি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দেখবে।

শ্রমিক লীগের কুমিল্লা মহানগর আহ্বায়ক ও সওজ কুমিল্লা সার্কেল অফিসের কম্পিউটার অপারেটর আনিসুর রহমান ভূঁইয়া। তার কুমিল্লা সদর উপজেলার শাকতলা এলাকার অফিসে গিয়ে দেখা যায়, কক্ষের সামনে লেখা কম্পিউটার অপারেটর, সড়ক ও যোগাযোগ অধিদফতর, কুমিল্লা সার্কেল। খালি অফিস কক্ষ।

অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সূত্রে জানা গেছে, একজন কম্পিউটার অপারেটর হয়েও আনিসের ছিল আলিশান চলাফেরা। নিজের গাড়িতে চলাফেরা ছিল তার। অফিসের সবার কাছে সবসময়ই স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের ভয় ঢুকিয়ে রাখতেন। সরকারি চাকরিরত অবস্থায় তিনি বিগত নির্বাচনগুলোতে আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের মেয়ে ও মেয়র তাহসিন বাহার সূচনার প্রচারণায় প্রকাশ্যে অংশ নেন। ৫ আগস্টের পর থেকে বিভিন্ন অজুহাতে তিনি কর্মস্থলে আসছেন না। এদিকে ছাত্রজনতার আন্দোলনে বাধা ও হামলার অভিযোগে একাধিক মামলার এজাহারনামীয় আসামি করা হয় এই কর্মচারীকে।

সওজ কুমিল্লা সার্কেল জোন অফিসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তিনি এখনও অফিসে আসছেন না। আমাদের কর্মকর্তারাও বিষয়টি জানেন। তিনি ছুটি নিয়ে অনুপস্থিত আছেন বলে জানি।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক ও সওজের কর্মচারী আনিসুর রহমানের বক্তব্য জানতে মোবাইল নম্বরে কয়েকবার কল ও মেসেজ দিলেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

একই অবস্থা কুমিল্লা জেনারেল (সদর) হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার নজরুলের। শেখ হাসিনা চলে যাওয়ার পর থেকে কর্মস্থলে নেই। তিনি মহানগর শ্রমিক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক।

অভিযোগ আছে, কোনোমতে প্রাথমিকের গণ্ডি পার হওয়া নজরুল ছিলেন সদর হাসপাতালের ত্রাস। তার আতঙ্কে থাকতেন চিকিৎসক, রোগী ও নার্সরাও। নিজের ইচ্ছায় নিয়োগ দিতেন আউটসোর্সিং কর্মচারী। ভিন্ন রাজনৈতিক মতের রোগীদের হাসপাতাল থেকে বের করে দিতেন। এ ছাড়া হাসপাতালের যাবতীয় বিষয় তার কথাতেই চলতো। নির্বাচনে তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য ও মেয়রের পক্ষে প্রকাশ্যে নির্বাচনি প্রচারণায় অংশ নিতেন। তার নামে রয়েছে ছাত্র আন্দোলনে হামলার অভিযোগে একাধিক মামলা।

কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. মো আবদুল করিম খন্দকার বলেন, ওয়ার্ড মাস্টার নজরুল ৫ আগস্টের পর থেকে হাসপাতালে আসছেন না। আমরা তাকে তিনটি শোকজ নোটিশ দিয়েছি। কিন্তু তিনি কোনও প্রতিউত্তর করেননি। পরে আমরা তা ডিজি অফিসে পাঠিয়েছি। তিনি এখন চাইলেও ডিজি অফিসের অনুমতি ছাড়া জয়েন করতে পারবেন না।

অনেক চেষ্টা করেও অভিযোগের বিষয়ে জানতে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এখনও কর্মস্থলে ফেরেননি কুমিল্লা মহানগর শ্রমিক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক হাসান মাহামুদ চৌধুরী সুমন। তিনি সোনালী ব্যাংকের কর্মচারী ও সোনালী ব্যাংক এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন-বি ২০২ কুমিল্লা অঞ্চলের সাধারণ সম্পাদক।

জানা গেছে, ২০১২ সালের পূর্বে তিনি কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক সম্পাদক ভিপি নুর উর রহমান মাহমুদ তানিমের অনুসারী ছিলেন। পরে যোগ দেন কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের গ্রুপে। এরপর বনে যান নেতা। তার কথায় চলতো সোনালী ব্যাংকের করপোরেট ব্রাঞ্চ। ৫ আগস্টের পর থেকে তিনিও লাপাত্তা।

এ বিষয়ে জানতে মো. হাসান মাহামুদ চৌধুরী সুমনকে একাধিকবার কল করে মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। পরে মেসেজ দিলেও কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সোনালী ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, তিনি ৫ আগস্টের পর থেকে অনুপস্থিত। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানেন।

সূত্র- বাংলা ট্রিবিউন।।

     আরো দেখুন:

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০  

You cannot copy content of this page